সিলেটজুড়ে অস্থিরতা, পরিবহনখাতে বিশৃঙ্খলা

সিলেট

হঠাৎ জ্বালানী তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সিলেটের সব সেক্টরে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। আরেক দফা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির আশংকাও দেখা দিয়েছে। রাত থেকেই বিভিন্ন পাম্পের সামনে বিক্ষোভ সহ রাস্তা অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার সকাল থেকেই সর্বত্র বিরাজ করছে উত্তেজনা। দিনভর নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
তেলের দাম বাড়ানোর পর প্রথম দিনেই সিলেটে কমে গেছে যান চলাচল। সড়কেও লোকজনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। দোকানপাটেও ক্রেতা ছিল কম। কাঁচা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে সিলেট। জ্বালানির দাম বাড়ার পরই সিলেটের পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। যাত্রীদের অভিযোগ, অনেক পরিবহন মর্জিমাফিক ভাড়া রাখছে।

এদিকে সুনামগঞ্জ আন্তজেলা রুটে বেড়েছে বাস ভাড়া। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ রুটে চলছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়। অরাজকতার শঙ্কায় বিভিন্ন রুটে যানবাহন কম নামানো হয়েছে। কয়েকটি রুটে বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার বাস। নগরী থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা উপজেলায় সিএনজি অটোরিক্সাতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের খবর পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে জ¦ালানী তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সিলেটজুড়ে।
শনিবার দিনভর নগরীর বিভিন্ন স্থানে জ্বালানী তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপি, যুবদল, বাসদ ও গণ অধিকার পরিষদের বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
জানা গেছে, শুক্রবার দিবাগত রাতে মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণার সাথে সাথেই সমগ্র সিলেটের শতকরা ৯০ ভাগ পেট্রোল পাম্ব বন্ধ রাখা হয়। শত শত মোটর সাইকেল ও যানবাহন এ পাম্প সে পাম্প ঘুরে খোলা থাকা হাতে গোনা কয়েকটি পাম্পে ভিড় করে। কিছু পাম্পে ১২টার আগে তেল বিক্রি বন্ধ করা হলে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন মানুষ। এসময় সিলেট-সুনামগঞ্জ রোডে মোটরসাইকেল দিয়ে রাস্তা অবরোধ করা হয়। এভাবে নগরীর আম্বরখানা, সোবহানীঘাট, মিরাবাজার, চৌকিদেখী, দক্ষিণ সুরমা সহ সকল পেট্রোল পাম্পের সামনে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নগরীর সবগুলো পেট্রোল পাম্পের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কিছু জায়গায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিলেও কিছু জায়গায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে দেখা গেছে পুলিশকে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, সবগুলো পেট্রোলপাম্পেই আগের দামে কেনা জ্বালানী তেল মজুদ রয়েছে। অথচ শুক্রবার দিবাগত রাত থেকেই নতুন দামে তা বিক্রি করা হচ্ছে। সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই পাম্পমালিকদের মুনাফা করার সুযোগ করে দিয়েছে। জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে সিলেটের পরিবহন সেক্টরে ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য শুরু করে দিয়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, জ্বালানী তেলের মূল্য বাড়ার পর সিলেটের পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কমে গেছে বাস চলাচল। যাত্রীদের অভিযোগ, অনেক পরিবহন সংস্থা মূল ভাড়ার চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়তি আদায় করা হয়েছে। শনিবার সিলেটের কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও কুমারগাও বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে শনিবার সকাল থেকে অন্যদিনের তুলনায় দুটি টার্মিনাল থেকে বাস ছাড়ছে অনেক কম। টার্মিনালে বাস সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও চলছে কম। এদিকে বাস কম চলাচল করায় দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। গাড়ি না পেয়ে অনেককে টার্মিনালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। অনেকে অতিরিক্ত ভাড়ায় সিএনজি অটোরিক্সায় গন্তব্যের পথে ছুটেছেন।
সিলেট-সুনামগঞ্জ রুটে জেলা বাস মালিক সমিতির উদ্যোগে সকাল থেকে ২০ টাকা আংশিক বেশী ভাড়া নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী ভাড়া আদায় হলেও মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ রুটে শনিবার বিকাল পর্যন্ত নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। এরপরও ঐ দুটি রুটে জনপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার অভিযোগ করেছেন যাত্রী সাধারণ।
বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিলেট বিভাগীয় সভাপতি ও সিলেট জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে তেলের বর্ধিত মূল্য কার্যকর হয়েছে। এরপরও শনিবার পর্যন্ত বাস ভাড়া বাড়ানো হয়নি। যদিও রাস্তায় যানবাহন তুলনামূলক কম ছিলো। শনিবার রাতে কেন্দ্রীয়ভাবে নতুন ভাড়া সমন্বয় করা হয়েছে এর আলোকে আজ রোববার নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। বিভিন্ন রুটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কোন অভিযোগ কেউ করেনি। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আগে সুনামগঞ্জ জেলায় নতুন ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। এব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলার পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।
তিনি বলেন, এক সাথে জ¦ালানী তেলের দাম এতটা বৃদ্ধি করা সঠিক হয়নি। এখানে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের কিছু করার নেই। কারণ তেলের দাম বাড়লে ভাড়া বাড়বে সেটা স্বাভাবিক। এতে জনগণের উপরই চাপ পড়বে। আমরা চাই তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পরিহার করুন। এরপরও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন যদি বর্ধিত তেলের দামের সাথে সমন্বয় করে ভাড়া নির্ধারণ করে দিলে আমরা সেই অনুযায়ী ভাড়া আদায় করবো।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)সুনামগঞ্জ জেলার সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী মোঃ রিয়াজুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ও বিআরটিএ এর সাথে পরামর্শ ছাড়া সুনামগঞ্জ জেলায় বাস ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বেআইনী। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে শনিবার সকাল থেকে কেউ বাস চালাতে চায়নি। এতে হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তির শিকার হতো। লিটার প্রতি ৩৫ টাকা বেশী দামে তেল কিনে কোন চালক লোকসান দিয়ে গাড়ী চালাতে রাজি হওয়ার কথা নয়। তাই আমরা মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য তাৎক্ষনিক ভাবে আংশিক ভাড়া বৃদ্ধি করেছি। তেলের দাম বৃদ্ধির হিসাবে ভাড়া ৩০ টাকা বাড়াতে হয়। কিন্তু আমরা মাত্র ২০ টাকা বাড়িয়ে কোন রকম যান চলাচল স্বাভাবিক রেখেছি। অন্যথায় মানুষ সীমাহিন দুর্ভোগের সম্মূখীন হতো।
যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের বাসভাড়া ছিল ১২০ টাকা। শনিবার সকাল থেকে যাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১৪০ টাকা। একই রুটে এসি বাসের ভাড়া ছিল ১৬০ টাকা, সেটা করা হয়েছে ১৯০ টাকা। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকার বাসের ভাড়া ছিল ৬৫০ টাকা। শনিবার সকাল থেকে ১০০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে।
হবিগঞ্জ জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, শনিবার বিকেল পর্যন্ত সিলেট-হবিগঞ্জ রুটে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়নি। তবে অনেক মালিক তাদের বাস চলাচল থেকে বিরত রয়েছেন। নতুন ভাড়া নির্ধারণের অপেক্ষায় অনেকে বাস বন্ধ রেখেছেন। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশী ভাড়া নেয়ার কোন অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। শনিবার রাতে কেন্দ্র থেকে নতুন ভাড়ার নির্দেশনা আসলেও আমরাও হবিগঞ্জ আন্তজেলা রুটে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করবো। যা রোববার থেকে কার্যকর হতে পারে।
মৌলভীবাজার জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সজীব আলী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, মৌলভীবাজার আন্তজেলা রুটে বাস ভাড়া বাড়ানো হয়নি। তাই কোন বাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার কথা নয়। এধরনের কোন অভিযোগ আমরা পাইনি। শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় ভাবে নতুন ভাড়া নির্ধারণ হবে। আমরা কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে মৌলভীবাজার আন্তজেলা রুটে ভাড়া সমন্বয় করবো। যা রোববার থেকে কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার্স, ডিস্ট্রিবিউটার্স এজেন্টস অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিলেট বিভাগের সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের আহমদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, রাত ১২টার পর থেকে সিলেটেও জ¦ালানী তেলের নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাতে ১২টার আগে পাম্প বন্ধ করার ব্যাপারে তিনি বলেন, সিলেটের অধিকাংশ পাম্প ১০টার পর বন্ধ থাকে। কয়েকটি পাম্প দিবা রাত্রী খোলার অনুমতি আছে। তারা ১২টার পরও বিক্রি করেছে। এখানে পাম্প কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *