সিলেটিদের বিলাসযীত্রার ইতিহাস

সিলেট

সিলেটকে দ্বিতীয় লন্ডন বলা হয়। এর কারণ হলো সিলেটিরা বহু আগে থেকে বিলাত যাত্রা করে বিলাতে অভিবাসী হয়েছিল। বিলাতে সিলেটিদের অভিবাসনের ইতিহাস ৩৫০ বছরের। অর্থাৎ শুরুটা হয়েছিল ব্রিটিশ আমল থেকে। এরপর পাকিস্তান আমল, বাংলাদেশ হওয়ার পরও অভিবাসন থেমে থাকেনি। জাহাজে কাজ নিয়ে বিলেত গিয়ে পূর্বতন সিলেটিরা যে ধারার শুরু করেছিলেন পরবর্তী সময়ে তাদের উত্তর পুরুষরা নানা ধরনের ব্যবসা, চাকরি, পড়াশোনা ইত্যাদি কারণে বিলাত গমন করেছেন ও পরে তারা সিলেটে নিজেদের স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছেন। ব্রিটিশ অর্থনীতিতে সিলেটিদের ক্যাটারিং স্বীকৃত বিষয়। সব মিলিয়ে বিলাতে সিলেটি ও সিলেটি সমাজ আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। সিলেটিদের বিলাত যাত্রার সূচনা থেকে নানা বিষয় নিয়ে এ লেখায় আলোকপাতের চেষ্টা করা হবে।

বর্তমানে সিলেটিদের সত্যিকার বৈশ্বিক পরিবার বলা হয়। কারণ তারা ছড়িয়ে আছেন সারা বিশ্বে। এর মধ্যে বিলাত আলাদা স্থান নেয়া আছে। সিলেটিরা বিলাতে গিয়েছিল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে তারা ফার্স্ট ক্লাস যাত্রী বা নাবিক হিসেবে যায়নি। গিয়েছিল ‘লস্কর’ হিসেবে। খালাসিদের মতো কর্মী তারা। মজার ব্যাপার, সমুদ্রযাত্রা করা বা সমুদ্র পাড়ি দেয়া এ মানুষের বসবাস ছিল সমুদ্র থেকে অন্তত ৩০ মাইল দূরে। কিন্তু কোম্পানির শাসনের বিষয়টি ছিল অন্যরকম। তারা ব্যবসা শুরু করল আর সে ব্যবসার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত হতে হলো বাংলার মানুষের। সে ধারায়ই সিলেটিরা হয়ে গেল সিম্যান।

সিলেটি লস্করদের আগে ভাবতে হয় ‘লস্কর’দের কথা। ধারণা করা হয়, ১৬৫০ সাল থেকেই কোম্পানির জাহাজে বাঙালিরা লস্কর হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। এরা ছিল সারেংয়ের অধীনে। কোম্পানির কাগজ থেকে দাউদ নামে একজনের উল্লেখ পাওয়া যায় যাকে লস্কর নিয়োগের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। বাঙালি লস্কর নেয়ার একটি কারণ হলো দীর্ঘ যাত্রায় কোম্পানির নিজস্ব সিম্যানদের মৃত্যু। এছাড়া পলায়নও নতুন কিছু ছিল না। ফলে ভারত থেকে ফেরার পথে তাদের লোকবল প্রয়োজন হতো, যা মেটাতে ভারতীয় সিম্যান নিয়োগ করা হতো। অষ্টাদশ শতকে লস্কররা বিলাতেও যে পরিচিত ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিসামুদ্দিনের ভ্রমণকাহিনী থেকে। তিনি লিখেছেন যে তার আগে বিলাতের মানুষ কেবল ‘হিন্দুস্তানি’ লস্করদের সঙ্গেই পরিচিত ছিল, অভিজাতদের দেখেনি। ১১৮০ হিজরির শাওয়াল মাসের ৯ তারিখ ছিল ১১৭০ বঙ্গাব্দের ১৩ মাঘ। মাঘের সেই শীতের দিনে হিজলি ঘাট থেকে মঁসিয়ে সোরভিল নামের একটি ফরাসি জাহাজে বাংলার মাটি ছেড়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিলেতের পথে যাত্রা করলেন মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন। খ্রিস্টীয় ঐতিহ্য অনুসারে সেটা ছিল ১৭৬৫ সাল। মোটামুটি তিন বছর বিলেতে কাটিয়ে ফিরলেন দেশে। ১৭৭৯ সালে রচনা করলেন এ সফরের বৃত্তান্ত ‘শিগার্ফ-নামা-এ-বিলায়েত’ বা বিলাতের আশ্চর্য কাহিনী।

সমুদ্র থেকে দূরে হলেও হাওর আর বিলের দেশ সিলেট। মেঘালয়, আসাম, মণিপুরের পাহাড় থেকে আসা ঢল এসব হাওর ও বিলের উৎস। মেঘনা নদীর সঙ্গে সঙ্গে এসব উৎসের পানিই সিলেটের নিচু অঞ্চলকে উর্বর করে রাখে। একটা সময়ে এখানে কৃষক চাষবাস করত। কিন্তু বর্ষা মৌসুম ছিল আলাদা। সে সময় সিলেটকে একটি ছোটখাটো সমুদ্রই মনে হতো। এ জলাভূমি অঞ্চলে প্রচুর মাছ উৎপাদিত হতো। সে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত এখানকার মানুষ। বর্ষার পর জমিতে হতো ধানের চাষ। শুধু তাই নয়। সিলেটে নৌকা নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠেছিল। জ্য দেলোসেঁ এখানকার নৌকা, মাঝি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন। উপনিবেশ পূর্ববর্তী দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে তার লেখায় এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া নীহার রঞ্জন রায় ও রণবীর চক্রবর্তী জানিয়েছেন, তৎকালীন সিলেটে কাঠের বড় বড় নৌকা তৈরি হতো। আরব ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সুগন্ধী, কাঠ, কাপড় নিয়ে যেতেন। পর্তুগিজ নাবিক ও ব্যবসায়ীদের লেখায়ও সিলেটের জাহাজ সম্পর্কে জানা যায়। মোগল বাদশাহ আকবরের সময়কালে তার নওয়ারার জাহাজগুলো সিলেটে তৈরি হতো এবং এগুলো ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের সেরা জাহাজ। ফলে এ অঞ্চলে নৌযানে কাজ করার মতো কর্মী তৈরি হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ কোম্পানির জাহাজে চাকরি করা তাদের জন্য সহজ হয়েছিল।

এছাড়া সিলেটে বন্যার একটি প্রবণতা আগেও ছিল, এখনো আছে। এ বন্যার কারণে নানা সময়ে সিলেটিদের ফসলের পাশাপাশি জমি-বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকটা জীবিকার তাগিদেই তাদের জাহাজী হতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সিলেটের জাহাজী, লস্করদের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেছে তারা সবাই নৌকা বা নৌযানের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এরা অনেকেই ভাগচাষী। এদের অনেকের ফসলি জমি আবার চা চাষের কারণে বেহাত হয়েছিল। এরপর তারা জাহাজে কাজ নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে এরা সিলেট থেকে গিয়েছিলেন বা সিলেটি ছিলেন তার প্রমাণ কি?

প্রমাণ বর্তমান সিলেটের বহু অধিবাসীর পূর্বপুরুষের বিলাতে অভিবাসন। কিন্তু এদের বিলাত যাত্রা বা বিলাতে অভিবাসন দেড় দুই শতাব্দী আগের ঘটনা। এর আগের অভিবাসী বা জাহাজীদের ঠিকানার হদিস পাওয়া মুশকিল। ইতিশামুদ্দিন যেমন বলেছেন যে তিনি ‘চাঁটগা ও জাহাঙ্গীরনগরের’ লস্করদের দেখেছিলেন। কিন্তু সে কালে সিলেটের আলাদা নাম উল্লেখ করার রীতি ছিল না। সে হিসেবে জাহাঙ্গীরনগরের অংশ হিসেবে সিলেটকে ধরা যায়। আর প্রথম পর্যায়ে যারা বিলাতে আসতেন তারা বসতি স্থাপন করতে যাননি। বসতি স্থাপনের বিষয়টি পরবর্তী সময়ে সময়ের প্রয়োজনে হয়েছিল। তবে সিলেট থেকে বিলাত যাওয়া প্রতিটি ব্যক্তিই যে অর্থনৈতিক প্রয়োজনে লস্কর হয়েছিলেন এমন না। যেমন মুশতাক কোরেশি বলেছেন, ‘সিলেটি নাবিকদের সবাই দরিদ্র কৃষক ছিলেন না। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, সেটা বাংলায় র্িছল তবে সিলেটে নয়। সিলেটি নাবিকরা সমাজের নিম্নস্তর থেকে আসেন না। তাদের প্রাথমিক শিক্ষাটা ছিল শিক্ষা বলতে পড়ালেখা না, তাদের জ্ঞান ছিল নানা বিষয়ে। লোককথা বা মুখে প্রচারিত নানা আখ্যান এমনকি কিছু লিখিত দলিলেও পাওয়া যায় যে সমুদ্রগামীদের মধ্যে অনেকেই ধনী কৃষক গোষ্ঠীর অংশ ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার বড় হলে সেখান থেকে একজনকে জাহাজে পাঠানো হতো। তাদের ধারণা ছিল এভাবে আয় বৃদ্ধি সম্ভব হবে।

সিলেটিদের বিলাত যাত্রার আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক কারণ ছিল ‘ঘর পালানো’। পরিবারের সদস্যদের ওপর রাগ করে বহু তরুণ ঘর পালাত। কেউ পালাত অপরাধ করে। ‘বিলেতে বাঙালি অভিবাসন’ গ্রন্থের লেখক ফারুক আহমদ জানাচ্ছেন, তার পিতামহ আব্দুর রহমান মুন্সি বিশ শতকের শুরুর দিকে পিতার ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা গিয়েছিলেন। ১৯০৮ সালের ১৩ মার্চ থেকে তিনি ব্রিটিশ মার্কেন্টাইল মেরিনে এক টার্ম কাজ করেছিলেন। সিলেটের রাণাপিং পরগনার গোয়াসপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের নিয়োগপত্রে তার স্থায়ী ঠিকানার জায়গায় হাওড়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

খোঁজ করে দেখা গেছে, একই গ্রামের আব্দুল মনাফ একটি মামলার আসামি হয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন। এরপর তিনি লস্করের চাকরি নেন। তিনি থিতু হয়েছিলেন বার্মিংহ্যামে। একই গ্রামের মাহমুদ আলী ও তৈয়ব আলী পালিয়েছিলেন কেননা তাদের মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়েছিল। মাহমুদ আলী লস্করের চাকরি নেন। তিনিও বার্মিংহ্যামে অভিবাসী হয়েছিলেন। সাধারণ একটি রীতি ছিল অভিবাসী হয়ে অর্থ উপার্যন করে দেশে ফিরে আসা। তৈয়ব, মাহমুদ কারো প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল না স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ডে বসবাস করার। কিন্তু শুরুর দিকে অনেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাধ্য হয়ে ইংল্যান্ডে থেকে গিয়েছিলেন। আর অন্যরা সেখানে নিজেদের কাজে উন্নতি করে না ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

সিলেটিদের লস্কর হওয়ার আরেকটি কারণ চুনের ব্যবসা। কোম্পানি আমলে সিলেট থেকে চুন রফতানি হতো। রবার্ট লিন্ডজি এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এই অঞ্চলে (সিলেট) এতো বিশুদ্ধ এলয় বা লাক্ষামুক্ত চুন পাওয়া যায় যা হিন্দুস্তানের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।’ চুন আহরণ, উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণন কাজে স্থানীয় বহু ব্যক্তি নিয়োজিত ছিল। তারা চুনসহ জাহাজে করে কলকাতা গমন করতেন। এছাড়া হাতির দাঁত, হরিণের শিং দিয়ে তৈরি চিরুনির খ্যাতি ছিল ভারতজোড়া। ১৭৬৯-৭০ সালে বাংলায় ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে এ দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি লোক মারা যায়। কিন্তু সে সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করার ঘটনা ঘটে। বাংলা ১১৭৬ সালে ঘটা এ দুর্ভিক্ষের আগের বছর (১৭৬৮) খাজনা এসেছিল ১ কোটি ৫২ লাখ চার হাজার ৮৫৬ টাকা। কিন্তু কোম্পানি দুর্ভিক্ষের পর ১ কোটি ৫৭ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৬ টাকা খাজনা তুলেছিল। এর কারণে অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়েছিল পরিবারগুলো এতে সন্দেহ নেই। ভেঙে পড়া অর্থনীতির কারণে জাহাজে কাজ নেয়ার জন্য অনেকে বাধ্য হয়।

লস্করদের সঙ্গে চা বাগান ও চা ব্যবসায়েরও সম্পর্ক আছে। সিলেটের চা বাগানের বেশির ভাগ মালিক ছিল ব্রিটিশ। তারা সিলেটে ব্যবসা পরিচালনার পর দেশে ফিরতেন এ দেশীয় চাকর নিয়ে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ: অ্যান ইন্ট্রোডাকশন বইয়ে ড. এফএস ভাট্টি লেখেন, ‘চা বাগানের ঔপনিবেশিক (ব্রিটিশ) মালিক ও কর্মকর্তারা স্বদেশে ফেরেন এবং তাদের কেউ কেউ সঙ্গে নিয়ে আসেন নিজেদের সিলেটি চাকর-বাকর।’ এ নিয়ে সিলেটে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। তবে ১৯৯১ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক জাগরণে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদিক শ ম আজম ফারুক এর শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘আমাদের সাংস্কৃতিক তত্পরতাকে আরও বিস্তৃত করতে হবে’। তিনি লেখেন, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে কতিপয় বাঙালি জাহাজ-কর্মচারীর বিলাত আগমন ও অবস্থানের মধ্য দিয়ে মূলত সূচনা হয়েছিল বিলাতে বাঙালি জনবসতির। তারপর ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে চা-শিল্পের সঙ্গে জড়িত কিছু কিছু শুমিক জীবিকার সন্ধানে বিলাত আগমনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে বিলাতে বাঙালি জনবসতি…।’

সিলেটিদের মধ্যে বিলাতে সর্বপ্রথম কে গমন করেছিলেন তা জানা যায় না। তবে নিয়োবি নামে এক নারীর সন্ধান পাওয়া যায়। তার নিবাস ছিল সিলেট। ১৭৯০-এর দশকের কোনো একসময় আসাম শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা উইলিয়াম রবিনসন ও তার বন্ধু উইলকিসের সঙ্গী হিসেবে বিলাতে আসেন নিয়োবি। তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তার পিতার সঙ্গে সাহেবরা রীতিমতো চুক্তি করেছিল। কিন্তু সেখানে তার এলাকা বা অন্যান্য কোনো তথ্য উল্লেখ ছিল না। নিয়োবির সঙ্গে রবিনসনের ব্যবহার ছিল খুবই ভালো। তিনি কয়েক মাস ধরে নিয়োবিকে মান্টুয়া, মিলিয়নেয়ার তৈরি শেখান। এছাড়া আরো নানা ধরনের কাজ শেখানো হয়েছিল। নিয়োবি যখন দেশে ফেরে, তখন তার কাছে নানা ধরনের আধুনিক বিলাতি পোশাক ও পোশাকের নমুনা ছিল।

নিয়োবির পরপর সিলেট থেকে বিলেত এসেছিলেন সৈয়দ উল্লাহ। ১৮০৯ সালে তিনি বিলাতে পৌঁছান। তার পরের গন্তব্য ছিল স্কটল্যান্ডের ব্যালকারেস। সেখানে সিলেটের একসময়কার কালেক্টর রবার্ট লিন্ডজির সঙ্গে দেখা হয়। লিন্ডজি তার আত্মজীবনীতে সৈয়দ উল্লাহর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। পরিচয়পর্বের বিষয়ে লিন্ডজি লিখেছেন সৈয়দ উল্লাহ প্রথমে তার নিবাস কলকাতা বলে উল্লেখ করেছিলেন। পরে তাকে পুনরায় প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, তিনি বাংলার সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা। লিন্ডজি লিখেছেন তিনি সমুদ্রসৈকতে মিস্টার স্মলের দরোজা পার করছিলেন। আর সৈয়দ উল্লাহ তাকে জানান যে তিনি আসলে মিস্টার স্মলের ছেলের ভৃত্য হিসেবে এসেছিলেন। আর মিস্টার স্মলের এ ছেলেটি ছিল জাহাজের পার্সার। মানে সৈয়দ উল্লাহও জাহাজী হয়েই আসেন। সৈয়দ উল্লাহর একটি বিশেষ গুণ ছিল ভালো রান্না করা।

সৈয়দ উল্লাহর পর বিলাতে যাওয়া যে লস্করের নাম পাওয়া যায় তিনি সিকন্দর আলী। ভারতবর্ষের চতুর্থ মুসলিম আইসিএস গজনফর আলী তার সম্পর্কে জানিয়েছেন। গজনফর ১৮৯২ সালে বিলাতে যান। ১৮৯৭ সালে আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি দেশে ফেরেন। তার ভাষ্য মতে, সে সময় পূর্ব লন্ডনে বহু সিলেটি লস্কর ছিল। এদের মধ্যে একজন ছিলেন সিলেটের জালালপুর গ্রামের সিকন্দর আলী। পূর্ব লন্ডনের ওয়েস্ট ইন্ডিয়া ডক রোডে তার একটি লজিং হাউজ ছিল। সেখানে অনেক সিলেটি লস্কর থাকতেন। সিকন্দর একজন ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করে লন্ডনে বসবাস করতেন। গজনফর আলী ক্যাম্ব্রিজ থেকে লন্ডনে এলে সিকন্দর আলীর বাড়িতেই উঠতেন।

ইংল্যান্ডে কেবল অভাবী মানুষজন যেত না সে কথা বলা হয়েছে। আর ধনী বা সচ্ছল মানুষের কথা উল্লেখ করতে গেলে ইতিশামুদ্দিনের নাম আসে তা তো বলাই হলো। এছাড়া আছেন ঘনশ্যাম দাস। তিনি ইতিশামুদ্দিনের আট বছর পর ইংল্যান্ডে আসেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্যাপ্টেন গ্রাহামের তিনি ছিলেন ফার্সি অনুবাদক। ১৭৭৭ সালে বাংলা থেকে একজন মুসলিম ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। তার নাম মুন্সি মোহম্মদ সাইদ। অবশ্য তার বাঙালিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে। এ ব্যক্তি পরবর্তী সময়ে শেখ দ্বীন মোহাম্মদ নামে পরিচিত হন। এর পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হলে উপমহাদেশের লোকজন ইংল্যান্ডে যেতে শুরু করে। কালাপানি পার হওয়া নিয়ে সংস্কার ছিল কিন্তু রামমোহন রায়ের বিলাত যাত্রার পর তা ক্রমেই কমে যায়।

ভারতীয় উপমহাদেশের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের বিলাত যাত্রার কারণে বাংলা থেকেও বিলাত যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। এর মধ্যে সিলেট অগ্রগণ্য। আরেক দফা এখানকার জনতা অভিবাসন শুরু করার পর তাদের আত্মীয়পরিজন থেকে শুরু করে উত্তরপুরুষও ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পায়। বিলাতে তাদের ব্যবসা ছিল মূলত ক্যাটারিং। শেখ দ্বীন মোহাম্মদ ১৮১০ সালে লন্ডনের অভিজাত এলাকা পোর্টম্যান স্কয়ারের জর্জ স্ট্রিটে ‘হিন্দুস্তানি কফি হাউজ’ শুরু করেন। সিলেটিদের মধ্যে সৈয়দ তফজ্জুল আলীর নামটি পাওয়া যায় সবার আগে। ১৯১৫ সালে তিনি ২৭ ভিক্টোরিয়া ডক রোডে নিজের নামে রেস্টুরেন্ট করেছিলেন। এর একটি অন্যতম কারণ ছিল লস্করদের সাহায্য করা। লস্কররা লন্ডনে গিয়ে পুরনো সিলেটিদের কাছেই উঠতেন।

এরপর সিলেটের অন্য অভিবাসীরাও ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট চালু করেন। এসব রেস্তোরাঁয় সিলেটি লস্করদের সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনের ডকে কাজ করা শ্রমিকরাও ডাল-ভাত খেতে আসত। ১৯১৬-৪৭ সাল পর্যন্ত লন্ডনে বাঙালি পরিচালিত ৫০টি রেস্টুরেন্টের বেশির ভাগের মালিক হিসেবে সিলেটিদের নাম পরিচয় পাওয়া যায়। রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি চালু করা হয় লজ। কেননা দিনকে দিন লস্কর ও ভাগ্যান্বেষীদের সংখ্যা বাড়ছিল। এরপর ইংল্যান্ড ও লন্ডনে সিলেটিদের আর কোনো কমতি হয়নি। তারা জাঁকিয়ে বসেছিলেন। লন্ডনের নানা ধরনের ব্যবসায় রেখেছিলেন অবদান। লস্কর থেকে তারা হয়েছিলেন সেখানকার সম্মানিত বাসিন্দা। যদিও সে সম্মান অর্জন করতে সময় ও পরিশ্রম লেগেছে। লন্ডনের বাইরেও তাদের বসতি স্থাপিত হয়। ইংল্যান্ড হয়ে ওঠে সিলেটিদের আরেকটি আবাস।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *