সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক ফয়জুল হক রাজু হত্যার ৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। প্রকাশ্যে খুন হওয়া রাজু হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ পিছিয়েছে ৭ বার। বিচার শুরুর ১৫ মাসে ৫৫ সাক্ষীর মধ্যে বাদিসহ মাত্র ৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া হয়েছে। ফলে বিলম্বিত হচ্ছে বিচারকার্য। তবে রাজু পরিবার আশাবাদী কম সময়ে ন্যায় বিচার পাবেন।
জানা যায়- ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট রাতে নগরের কুমারপাড়ায় নির্বাচিত সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বিজয় মিছিল পরে মোটরসাইকেলে বাসার ফেরার পথে গতিরোধ করে ছাত্রদল ক্যাডার আব্দুর রকিব চৌধুরীর নেতৃত্বে হামলা চালায় ছাত্রদল ক্যাডার। এসময় গুলিতে জাকির হোসেন উজ্জ্বলের আহত হন। মোটরসাইকেল থেকে রাস্তায় পড়ে গেলে তারা রাজুকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করা হয়। স্থানীয়রা রাজুকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্তে রাজুর শরীরে ৪০টিরও বেশি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এ ঘটনায় রাজুর চাচা দবির আলী বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার অভিযোগপত্রে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ ৫৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। রাজু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৬ আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন জাকির হোসেন উজ্জ্বল, সালাউদ্দিন লিটন, মঈনুল করিম ও নজরুল ইসলাম।
এ মামলা সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের (বিশেষ দায়রা) জজ শাহরিয়ার কবিরের আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে- গেল বছরের ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার ২৬ আসামীর মধ্যে ২১ আসামীর উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে রাজু হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর আদালত ২২ এপ্রিল সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখও নির্ধারণ করেন। কিন্তু আসামিপক্ষ মোট ৭ বার সময় চেয়ে আবেদন করায় দফায় দফায় সাক্ষ্যগ্রহণ বিলম্বিত হতে থাকে। ফলে বিচার শুরুর ১৫ মাসে মাত্র ৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৩ আগস্ট বুধবার মামলার ৪র্থ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এর আগে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণের ৮ম তারিখে প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। ওইদিন মামলার বাদী মো. দবীর আলী তার সাক্ষ্য দেন।
বিচার শুরুর আগেও গতবছরের ৪ জানুয়ারি, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ৮ মার্চ ও ২৫ মার্চ সময় চেয়ে আদালতে আবেদন করেন আসামিপক্ষ। এভাবে বার বার সময় চেয়ে আবেদন করা হলেও শেষ পর্যন্ত আদালত ওই আবেদনকে আমলে না নিয়ে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষীর প্রতি সমন ইস্যুর আদেশ দেন।
এর আগে ২০১৯ সালের ২৮ মে এ হত্যা মামলায় সিলেট জেলা ছাত্রদলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দিনার ও মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রকিবসহ ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক অনুপ চৌধুরী। অভিযোগপত্র নম্বর ১৭৫।
তদন্ত কর্মকর্তার সুপারিশের ভিত্তিতে আলোচিত এই হত্যা মামলা থেকে শাহিন আহমদ ও কায়েছ আহমদ নামে দুইজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে আসামিরা হলেন- ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়ার আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীর পুত্র আব্দুর রকিব চৌধুরী (৩৭), নগরীর তেররতনের বজলুল হোসেন প্রকাশ বজলু মিয়ার পুত্র দেলোয়ার হোসেন দিনার (২৯), ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের বেতকুড়ির আব্দুল বারি প্রকাশ আব্দুল বারিক এর পুত্র এনামুল হক (৩১), একই উপজেলার বাঘাইতলা গ্রামের আব্দুল বারি প্রকাশ আব্দুল বারিকের পুত্র একরামুল হক (২২), দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দির মৃত সুলেমান আলীর পুত্র মো. মোস্তাফিজুর রহমান (৩১), হবিগঞ্জ সদরের পইল মোল্লা বাড়ির মৃত শেখ সাজিদ মিয়ার পুত্র শেখ মো. নয়ন মিয়া (৩০), শাহজালাল উপশহরের সৈয়দ রেজাউল হকের পুত্র সৈয়দ আমিরুল হক সলিড (৩৭), তেররতনের মৃত বাবুল মিয়ার পুত্র ফরহাদ আহমদ (২৮), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের শ্রীঘর গ্রামের আব্দুল শুকুরের পুত্র সাদ্দাম হোসেন (৩১), সোনারপাড়ার মৃত মতিউর রহমান খানের পুত্র মুহিবুর রহমান খান রাসেল (১৮), তেররতনের দুলাল মিয়ার পুত্র রাসেল আহমদ ওরফে রাসেল ওরফে কালা রাসেল ওরফে কানা রাসেল (১৮), কানাইঘাটের ছোটদেশের (সত্তিপুর) মৃত কুদরত উল্লাহর পুত্র আরাফাত এলাহী প্রকাশ বাবু (৩৩), আলফু মিয়া, বিয়ানীবাজারের বালিঙ্গার মোফাক্কর আলী চৌধুরীর পুত্র মোফাজ্জল চৌধুরী মুর্শেদ (২৬), ছাতকের তাঁতীকোনার মৌলভী আব্দুল হক ওরফে আব্দুল হক (২য়) বাবুল মিয়া এর পুত্র শহিদুল হক সুফিয়ান (৩০), দক্ষিণ সুরমার গোয়ালগাঁওয়ের মৃত ইসলাম মিয়ার পুত্র নজরুল ওরফে জুনিয়র নজরুল (২৫), রায়নগরের (মিতালী ২৫), সিরাজুল ইসলামের পুত্র ফাহিম আহমদ তোহা (২৮), বিয়ানীবাজারের জন্দরপুরের মৃত আতিকুল হক চৌধুরীর পুত্র আফজাল প্রকাশ আবজল আহমদ চৌধুরী (৩০), দক্ষিণ সুরমার সিলামের (আখিলপুর) মৃত আব্দুল মালিক প্রকাশ মানিক চৌধুরীর পুত্র সাহেদ আহমদ চৌধুরী (২৫), তাহিরপুরের গোবিন্দশ্রী গ্রামের মৃত আব্দুল গফফারের পুত্র রুবেল মিয়া (২৪), দিরাইয়ের ভাটিপাড়ার আতাউল করিমের পুত্র মামুন আহমদ (২৫), জকিগঞ্জের নিলাম্বরপুরের মৃত ফরিদ উদ্দিন চৌধুরীর পুত্র জুমেল আহমদ চৌধুরী (২৯), সিলেট শহরতলীর মীরেরচকের মৃত ইরশাদের পুত্র মুহিত ওরফে মুহিব (৩০), দক্ষিণ সুরমার চান্দাই পশ্চিমপাড়ার সৈয়দ শফিকুল কাদি বাচ্চু মিয়ার পুত্র মুর্শেদ আলম প্রকাশ রাহেল আহমদ (৩০), নগরীর ঝর্ণারপাড়ের টেনাই মিয়ার পুত্র জাবেদ আহমদ প্রকাশ জাবেদ (৩০) এবং লাখাই উপজেলার মোড়াকুড়ি গ্রামের শফিকুল ইসলামের পুত্র জামাল মিয়া প্রকাশ জালাল (২৩)।
তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৩/৩৪১/১১৪/৩০৭/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০২/৩৭৯/৪২৭/৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
কিন্তু এরপর জামিনে থাকা আসামি আলফু মিয়া, ফাহিম আহমদ ওরফে তোহা ও জুমেল আহমদ চৌধুরী পালিয়ে যান। বর্তমানে তাদের কোনো খোঁজ নেই। এর আগে হত্যাকাণ্ডের পরই গোপনে লন্ডনে পালিয়ে যান প্রধান আসামি আব্দুর রকিব চৌধুরী। এছাড়াও শহিদুল হক সুফিয়ান, সাহেদ আহমদ চৌধুরী, মুর্শেদ আলম প্রকাশ রাহেল আহমদ, জাবেদ আহমদ ওরফে ছেঁচড়া জাবেদ ঘটনার পর থেকেই পলাতক। বর্তমানে মোট ২৬ আসামির মধ্যে ৮ জন পলাতক রয়েছে। আর ১৮ আসামি জামিনে রয়েছেন।
সিলেট মহানগর দায়রা জজ মো. আব্দুর রহিমের আদালতে মামলার কার্যক্রম চলাকালে ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে দ্রুত বিচার ও নিষ্পত্তির জন্যে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
এ বিষয়ে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট সরওয়ার আহমদ চৌধুরী আবদাল বলেন, বাদীসহ এখন পর্যন্ত ৪ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা সবাই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। আগামী রোববার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য্য রয়েছে। দ্রুত ন্যায় বিচার পেতে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হচ্ছে।
মামলার বাদি ও রাজুর চাচা সিলেট জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. দবীর আলী আদালতের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুতগতিতেই চলছে। আশা করি কম সময়ের মধ্যে ন্যায় বিচার পাব। প্রকাশ্যে আমার ভাতিজাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আমরা ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট রাতে নগরের কুমারপাড়া পয়েন্টে নগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক ফয়জুল হক রাজুকে ছাত্রদলেরই আরেক গ্রুপের ক্যাডাররা এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। এছাড়া রাজুর সঙ্গী জাকির হোসেন উজ্জ্বল প্রাণে রক্ষা পেলেও সে এখন পঙ্গু নিয়ে বেঁচে আছে। রাজু ছাত্রদলে সম্পৃক্ত থাকলেও তার পুরো পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনেরা বংশ পরম্পরায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত রয়েছেন।