
# ২২ উপজেলার মধ্যে পোস্ট মাস্টার নেই ২০টিতে
# ৬৯ পোস্ট অপারেটরের মধ্যে খালি ২০টি
# ১৭৩ পোস্টম্যানের মধ্যে খালি ১২৮ টি
# সিলেটের নিয়োগ পরীক্ষা দিতে হয় চট্টগ্রামে
# গত ডিসেম্বরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হলেও নিয়োগের খবর নেই
মুনশী ইকবাল :
জনবল সংকট, নিয়োগ নেই, সিলেটের নিয়োগ পরীক্ষা দিতে হয় চট্টগ্রামে, পোস্ট অফিসগুলো অবকাঠামোগত জীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ, বাজেট সংকট, সম্ভাবনাময় খাতে বাস্তব পদক্ষেপের অভাবসহ নানান কারণে সিলেটের ডাক বিভাগ পাহাড় পরিমাণ সংকটে জর্জরিত। এতে একদিকে যেমন ঐতিহ্য হারাচ্ছে এই বিভাগ, অন্যদিকে কাঙ্খিত সেবা প্রদানেও ব্যর্থ হচ্ছে।
পণ্য পার্সেল, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকসহ যে দুই একটি খাতে গ্রাহক কাটতি উর্ধ্বমুখী এবং সম্ভাবনাময় সেগুলোও নানান জটিলতায় আক্রান্ত। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে যেমন রাষ্ট্র আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি জনগনও প্রাপ্য সেবা থেে ক বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রধান পরিসেবাসমূহের মধ্যে রয়েছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ডাক দ্রব্যাদি গ্রহণ, পরিবহন ও বিলিকরণ, রেজিস্ট্রেশন সেবা, ভ্যালু পেয়েবল (ভিপি) সেবা, বীমা সেবা, পার্সেল সেবা, বুক পোস্ট (বুক প্যাকেট ও প্যাটার্ণ প্যাকেট), রেজিস্টার্ড সংবাদপত্র, মানি অর্ডার সেবা, এপ্রেস সেবা (জিইপি ও ইএমএস), ই-পোস্ট এবং ইন্টেল পোস্ট সেবা প্রদান। সাধারণত দূরত্ব এবং গন্তব্য যোগাযোগ উপর নির্ভর করে এ কাজে ২ থেকে ৩ দিন সময় লাগে। সিলেট অঞ্চলে এই অবস্থা আরও প্রকট। ফলে লোকজন দ্রুত সেবার জন্য বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু কুরিয়ারগুলো কেবল উপজেলা পর্যায়ে সেবা প্রদান করে। অপরদিকে ডাক বিভাগের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের দোরগোড়ায় সেবা, চিঠি পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ আছে। তবে জনবল বা পোস্ট ম্যানের সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না।
সিলেট পোস্টাল ডিভিশনাল অফিস সূত্রে জানা গেছে, এই অফিসের অধীনে সিলেট বিভাগে ২২টি উপজেলা রয়েছে। এই ২২টি উপজেলার মধ্যে কেবল ২টি উপজেলা ডাকঘরে পোস্ট মাস্টার আছেন, বাকি ২০টি পদই খালি রয়েছে। পোস্ট অপারেটরের মঞ্জুরকৃত পদ রয়েছে ৬৯টি, এর মধ্যে লোক আছেন ৪৯টি, বাকি ২০টি পদ খালি। পোস্টম্যানের মঞ্জুর পদসংখ্যা আছে ১শ ৭৩ টি, কিন্তু এরমধ্যে মাত্র ৪৫ জন কর্মরত। বাকি ১শ ২৮টি পদই শূণ্য।
গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলো শূণ্য থাকায় মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ডাক বিভাগকে। বিশেষ করে পোস্টম্যানের তীব্র এই সংকটে একেকজনকে কয়েকটি উপজেলায় চিঠিপত্র বিলির কাজ করতে হয়। এতে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হয় গ্রাহককে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কারণ এসব জায়গায় পোস্ট কয়েকদিনে গেলে তবেই তারা চিঠি, সেবা ইত্যাদি পেতে পারেন। এসব কারণে মানুষ দাম বেশি হলেও বেসরকারি কুরিয়ারের দিকে ঝুঁকে গিয়েছেন।
সমাজসেবী ও সংগঠক সাজন আহমদ সাজু জানান, একসময় ডাকে চিঠিপত্র পাঠানোর জন্য আগ্রহ থাকলেও বর্তমানে তা আগের মতো নেই। মুহূর্তে যেখানে ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বার্তা আদান প্রদান করা যায় সেখানে চিঠিপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে গেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস হার্ডকপি পাঠানো লাগে। এজন্য ডাকের প্রয়োজন হয়। তবে সরকারি ডাকে কাগজপত্র যেতে অনেক দেরি হওয়ায় বেসরকারি কুরিয়ারেই সবাই বেশি ধর্না দেন।
এ ব্যাপারে সিলেট ডাক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মূলত লোকবল সংকটের কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। একজন লোককে অনেকের কাজ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে পোস্টম্যানদের অনেকগুলো এলাকা কাভার করতে হয়। এতে একদিনের কাজ কয়েকদিন লেগে যায়।
নতুন জনবল নিয়োগের ব্যাপারে গতবছরের ডিসেম্বরে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু বাজেটের জন্য তা আটকে আছে।
নিয়োগের ব্যাপারে জানা যায়, সিলেট বিভাগ এখনও চট্টগ্রাম সার্কেলের অধীন। ফলে সিলেট বিভাগের পরীক্ষা চট্টগ্রামে গিয়ে দিতে হয়। সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অনেক দূরে হওয়ায় অনেকেই এতে আগ্রহী হন না। যারা পরীক্ষা দিতে যান তারা সিলেট থেকে দীর্ঘ জার্নিতে ক্লান্ত বা অসুস্থ হয়ে পরীক্ষায় স্বাভাবিকভাবে অংশ নেওয়ার অবস্থায় থাকেন না। ফলে তাদের পরীক্ষাও সবার আশানুরূপ হয় না। এই সুযোগে চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকেরা পরীক্ষায় ভালো করার সুযোগ পায়। নিয়োগের পরই তারা নিজ বিভাগে বদলির তৎপরতা চালান। এতে সিলেট অঞ্চলের প্রতি তাদের কোনো টান থাকে না। একসময় তারা বদলি হয়ে গেলে আবারও শূণ্যতা তৈরি হয়।
খবর নিয়ে জানা গেছে, লোকবল সংকটের মধ্যে আরেক সংকট অবকাঠামোগত জীর্ণতা। বেশিরভাগ প্রত্যন্ত এলাকার পোস্ট অফিসগুলোর অবস্থা খুব নাজুক। আবার যেসব অফিসে নতুন করে অবকাঠামো নির্মাণ হয় সেগুলোও সঠিত তত্ত্বাবধানের অভাবে জীর্ণতার দিকে চলে যায়। মূলত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার ও পরিমাণে কারচুপি করায় এমনটা হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। এক্ষেত্রে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিয়োগে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে তারা মনে করেন।
এত সংকটের মধ্যেও আর্থিক খাতে এবং পার্সেলে লোকজনের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে রাষ্ট্রীয় ডাকের প্রতি। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ (ইএমটিএস) কম খরচে টাকা পাঠানোর জন্য এটি একটি জনপ্রিয় ও সরকারি সেবা। দেশের মোট ২ হাজার ৭শ ৫০টি পোস্ট অফিসে এই সেবাটি চালু আছে, যেখানে নিরাপদে ও দ্রুত টাকা পাঠানো যায়। সাধারণত অন্যান্য মাধ্যমে টাকা পাঠালে খরচ অনেক কেটে নেয় কিন্তু বাংলাদেশ ডাকের মাধ্যমে পাঠালে তা অনেক কম। তবে এটা যেকোনো পোস্ট অফিসে গিয়ে পাঠাতে ও তুলতে হয়। ডাক বিভাগের আরেকটি আস্থাশীল আর্থিক মাধ্যম ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক। পার্সেলের পর সবচেয়ে বেশি গ্রাহক ডাকের এই সেবা নিয়ে থাকেন। এর মুনাফা অনেক বেশি এবং নিরাপদ হওয়ায় যারাই এটি ব্যবহার করেন তারা আশ^স্ত থাকেন।
বাংলাদেশ ডাকের সবচেয়ে বেশি গ্রাহক ব্যবহার করেন পার্সেল ব্যবস্থা। সাধারণ কুরিয়ারের চেয়ে অনেক কম খরচে এবং নিরাপদে বিদেশে মালামাল পাঠানোর জন্য এটি অনেক জনপ্রিয়। এমনকি দেখা গেছে, অনেক বেসরকারি কুরিয়ারের লোকজনও গ্রাহকের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে বাংলাদেশ ডাকের কুরিয়ারে পণ্য পাঠান। তবে সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীরা এক্ষেত্রে একটি সমস্যার কথা জানিয়েছেন। সিলেট থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশে পণ্যের চাহিদা থাকে শুটকি ও চা-পাতার। কিন্তু ডাকের পার্সেলে শুটকি ও চা-পাতা পাঠানো যায় না। যদি তা করা যেত তবে গ্রাহক সংখ্যা অনেক বেড়ে যেত।
নগরীর শিবগঞ্জের দাইয়ান চৌধুরী জানান, বাংলাদেশ ডাকের সাথে আমাদের আবেগ অনুভূতি জড়িত। এখন মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে চিঠিপত্রের তেমন কোনো প্রয়োজন না হলেও বিদেশে আত্মীয় স্বজনের কাছে সাশ্রয়ী দামে পণ্য পাঠানো যায়। তবে শুটকি এবং চা-পাতা পাঠানো যায় না। তাই চা-পাতা ও শুটকির বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।
সার্বিক বিষয়ে সিলেট পোস্টাল ডিভিশনাল অফিসের ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল সুজিত চক্রবর্তী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ডাক বিভাগ এখন আগের চেয়ে অনেক অত্যাধুনিক। তবে জনবল সংকট এবং নানান নিয়মের বেড়াজালের জনগণকে তাদের সেই কাক্সিক্ষত সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। ডাক ব্যবস্থা যেমন আধুনিকায়ন করা হয়েছে, তেমনি অন্যান্য নিয়ম কানুনও পুর্নবিবেচনা করা গেলে আরও সহজে গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করা যেত। পার্সেলের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমাদের অফিসে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক গ্রাহক বিদেশে পণ্য পাঠানোর জন্য আসেন। সিলেট অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে শুটকি ও চা-পাতার প্রতি। তবে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ দুটি পণ্য পার্সেল করা সম্ভব হয় না। প্রতিদিন অনেক গ্রাহক শুটকির জন্য এসে ফিরে যান। যদি শুটকি ও চা-পাতা পার্সেলের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে গ্রাহক সংখ্যা আরও বাড়বে।
শেয়ার করুন


