সিলেটে একে একে বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হলের দুয়ার

সিলেট

একসময় সংস্কৃতির স্বাদ ও বিনোদন পাওয়ার স্থান ছিলো সিনেমা হল। নতুন কোনো সিনেমা বের হওয়ামাত্র বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা হয়তো ভুলে গেছেন অনেকেই। কারণ- সেই চিত্র হারিয়ে গেছে গেল বেশ কয়েক বছর ধরে।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও সারা দেশে ১ হাজার ৪৩৫ টির মতো সিনেমা হল সচল ছিলো। সেখানে এখন সচল আছে কেবল মাত্র ৬০টি। কেনো এই দুর্দশা সিনেমা হলগুলোর? ডিস চ্যানেল, স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় সিনেমা দেখতে এখন আর মানুষ সিনেমা হলমুখো হন না। তাছাড়া মানসম্পন্ন সিনেমার অভাব ও দর্শকদের চাহিদামতো হলের পর্দা ও পরিবেশ না থাকায় হলবিমুখ হয়ে পড়েছেন সিনেমার দর্শকরা। ফলে একে একে বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হলগুলো, এ ব্যবসায় দেখা দিয়েছে মন্দাভাব ।

একই অবস্থা সিলেট মহানগরীর সিনেমা হলগুলোরও। সিলেটের নয়টি সিনেমা হলের মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র দুইটি। বাকি ৭টি হলই বন্ধ হয়ে গেছে। সচল দুইটি সিনেমা হলও সার্বিক অবস্থায় ভালো নেই।

জানা গেছে- কয়েক বছর আগেও সিলেট মহাগরীর নন্দিতা, দিলশাদ, অবকাশ, লালকুঠি, রঙমহল, মনিকা, কাকলি, বিজিবি ও জালালাবাদ সৈনিক- এই নয়টি সিনেমা হলে নিয়মিত সিনেমা প্রদর্শন করা হতো। দর্শকদের পদচারণায় মুখর থাকতো এসব হল। কিন্তু এখন আর সে চিত্র নেই। যে দুইটি কোনোরকম টিকে আছে সেগুলোতেও দর্শকের আকাল। সিনেমা হলে ছবি দেখার সুন্দর পরিবেশও নেই।

সিলেটে চালু থাকা দুইটি হলের মধ্যে একটি হচ্ছে আখালিয়া এলাকার বিজিবি অডিটরিয়াম, অপরটি তালতলার নন্দিতা। বন্ধ হওয়া সাতটির মধ্যে ‘অবকাশ ও রঙমহল’ সিনেমা হল দুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে বহুতল ভবন ও মার্কেট। বন্ধ হওয়া অপর চারটির মধ্যে তালতলার দিলশাদ সিনেমা হলে ঝুলছে ‘বিক্রয় বিজ্ঞপ্তি’। এছাড়া বন্ধ রয়েছে লালকুঠি, মনিকা ও কাকলি, জালালাবাদ সিনেমা হল।

মানসম্পন্ন সিনেমার অভাব ও দর্শকদের চাহিদামতো হলের পর্দা ও পরিবেশ না থাকায় বাকি যে দুইটি চালু আছে সেগুলোর দুয়ারও একসময় বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়- মান্ধাতা আমলের আসন দিয়েই কোনো রকমে চলছে তাদের ব্যবসা। বাড়েনি দর্শকসেবাও। ছবি চলাকালে ছারপোকাসহ মশাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিনোদনের স্বাদ নিতে হয় দর্শকদের।

তবে এসবের মধ্যেও আশার মুখ দেখছেন সিনেমাপ্রেমীরা। এয়ারপোর্ট সড়কে নতুন উদ্বোধন হওয়া ‘গ্র্যান্ড সিলেট সিনেপ্লেক্স’ দর্শক টানবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

নগরীর তালতলায় নন্দিতা সিনেমা হলে ছবি দেখতে আসা লিডিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র সুজন মাহমুদ বলেন, ভালো সিনেমা না হলে কেউই দেখতে চান না। আর ইংরেজি সিনেমা দেখতে দেখতে বাংলায় অনিহা চলে এসেছে। ভালো সিনেমা হলে অনেকেই দেখতে আসেন। অনেক দিন ভালো সিনেমা আসে না।

শাবি শিক্ষার্থী বিথি বলেন, মানসম্মত সিনেমার অভাবে আমাদের জেনারেশন বাংলা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তবে ইদানিং ভালো কিছু সিনেমা আসছে। আস্তে আস্তে বাংলা সিনেমা হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে- এটাই প্রত্যাশ।

হলে আসা আরেকজন বলেন- কীভাবে সিনেমা দেখতে আসবো? হলের ভিতরের অবস্থা খুবই খারাপ। সিটগুলো ভালো না। পর্দা ঘোলাটে। হলের ভিতর দুর্ঘন্ধ তো আছেই। এর মধ্যে সিনেমা দেখতে গেলে মশার কামড়ে দিশেহারা অবস্থা হয়।

নন্দিতা সিনেমা হলের আপারেটর সুবল দাস সিলেটভিউ-কে জানান, ভালো ছবি হলে দর্শক হয়। তবে আগের মতো হয় না। খারাপের মধ্যে ভালো আরকি।

তিনি বলেন, ব্যবসা ভালো নয় বলে বেশিরভাগ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ইদানিং কিছু ভালো সিনেমা আসছে, সেগুলো দর্শক টানছে। ভালো সিনেমা বাজারে আসলে হল ব্যবসা আবারও  চাঙা হতে পারে। একই সাথে হলেরও মান আরো ভালো হবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

আখালিয়া এলাকার বিজিবি অডিটরিয়ামের ম্যানেজার শাওন দাস রায় বলেন- করোনার কারণে প্রায় পুরো দুই বছর বন্ধ ছিলো সিনেমা হল। এর মধ্যে ভালো সিনেমা না বের হওয়ায় মানুষ হিন্দি আর সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমা বেশি দেখছে। মানুষকে হলমুখি করতে হলকে নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সিনেমা হলগুলো দুর্দশার বিষয়ে জেলা তথ্য অফিসের পরিচালক উজ্জল শীল সিলেটভিউ-কে বলেন, একটা সময় পরিবারের সবাইকে নিয়ে হলে ছবি দেখা ছিলো একটি সংস্কৃতি। তবে এখন আর সে দৃশ্য দেখা যায় না। তবে ভালো সিনেমা তৈরি হলে মানুষ আবার সিনেমা দেখতে হলে যাবে।

তিনি বলেন- এখন মাঝে-মধ্যে অবশ্য ভালো সিনেমা তৈরি হচ্ছে। আশা করা যায়- আস্তে আস্তে মানুষ আবারো হলমুখী হবেন।

উজ্জল শীল আরও বলেন- সরকার উন্নত সিনেমা হল তৈরির জন্য স্বল্পমূল্যে ঋণ দিচ্ছে। কোনো উদ্যোক্তা চাইলে এই সুবিধা নিতে পারেন। বাংলা সিনেমার একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। আশা করছি সংশ্লিষ্টদের সময়োপযোগী চিন্তা-চেতনা এবং কর্মদক্ষতার ফলে সেটি একদিন ফিরে আসবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *