সিলেটে কোথাও পানি কমেছে, কোথাও বেড়েছে

সিলেট

সিলেটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমায় অনেক এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করলেও কোথাও কোথাও বাড়ছে। তবে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।

 

জেলায় বুধবার রাতে কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়নি। উজান থেকে নেমে আসা ঢল অব্যাহত থাকায় জেলার প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ফেঞ্চুগঞ্জ ও কানাইঘাটে প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। বন্য পরিস্থিতির মধ্যেই গোয়াইনঘাটে নৌকা ডুবে নিখোঁজ এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, সিলেটের প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার ছয়টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে গোয়াইনঘাটের সারি নদীর পানি সকাল থেকে বিপৎসীমার নিচে রয়েছে।

 

এ দিন সকালে সিলেট নগরীর তালতলা, জামতলা, মাছুদিঘীরপাড়, উপশহর, যতরপুর, সোবাহানীঘাট, মীরাবাজার, মেন্দিবাগ, শিবগঞ্জ, তোপখানা, বেতেরবাজার এলাকার বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাটের কোথাও কোথাও হাঁটুসমান পানি দেখা গেছে।

এসব এলাকার পানিবন্দি বাসিন্দারা বলছেন, ময়লা পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হচ্ছে তাদের। সকালে পানি একটু ‘কমেছে’। তবে বৃষ্টি শুরু হলে আবার বেড়ে যাবে।

 

কোম্পানীগঞ্জের বাসিন্দা ও স্থানীয় সাংবাদিক কবির আহমদ বলেন, “উপজেলার কিছু মানুষের বাড়িঘর থেকে বন্যার পানি নেমেছে। তবে বেশির ভাগ এলাকায় রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়িতে এখনও পানি রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বুধবারের তুলনায় আজকে পানি একটু কমেছে।”

 

সিলেট নগরীর উপশহরের ডি ব্লকের বাসিন্দা আহমেদ চৌধুরী বলেন, “ঈদের দিন তো বাসার নিচ তলায় পানি প্রবেশ করেছিল। পানির জন্য ঠিকমত ঈদের আনুষ্ঠিকতাও করতে পারি নাই। আজও বাসায় পানি রয়েছে।

 

“বন্দির মতো দিনকাল যাচ্ছে; তবে পানি একটু নেমেছে।”

 

জামতলার দোকানি সোহেল মিয়াকে পানির জন্য দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। বেচাবিক্রি নেই; তাই খানিকটা চিন্তিত দেখা গেল তাকে।

 

সোহেল মিয়া বলছেন, “গত কয়েকদনি ধরে এক অবস্থা। পানি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে সকাল থেকে মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি আগের থেকে একটু ভালো।”

 

ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টির ওপর সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির বিষয়টি নির্ভর করে জানিয়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক বলছেন, “সিলেটে বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতেও বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমেছে। পাহাড়ি ঢল নামার ফলে নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।”

বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে তিন ঘণ্টায় সিলেটে ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন জানিয়েছেন।

সজীব বলেন, “গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে বুধবার রাতে কোনো বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়নি। সিলেটে আগামী দুই দিন মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।”

বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।সিলেট জেলা ও নগর মিলিয়ে ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২১ হাজার ৭৮৬ জন পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, “সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির এখন অবস্থা হল- কোথাও পানি কমেছে; আবার কোথাও বেড়েছে। তবে কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্ট ছাড়া অন্য নদ-নদীরগুলোর পানির লেভেল আগের থেকে নেমেছে।

“বন্যার্ত এলাকায় প্রশাসনের ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির উপর সর্তক দৃষ্টি রাখছে।”

এর আগে বুধবার বিকালে জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সিলেট নগরীর ২৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ১০৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। সিলেট জেলা ও নগর মিলিয়ে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে মহানগরে রয়েছে ৮০টি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৫৯ জন আশ্রয় নিয়েছেন।

জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়েছেন। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ২২৩টি গ্রামের ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। তার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ১ হাজার ৪৪০ জন মানুষ। প্রধান প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়ায় সিলেট জেলার সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

জেলা প্রশাসন বলছে, সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১১৩টি গ্রামের ৯৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৭ হাজার ৩০৩ জন। উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বাদে বাকি সকল সড়ক পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। যার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারতেছেন না।

বৃহস্পতিবার পানি একটু কমেছে জানিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টি ওয়ার্ডের ১ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। নগরীতে ৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ২২টি কেন্দ্রে মানুষজন উঠেছেন। সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্দেশনায় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বন্যাকবলিত এলাকায় রান্না করা ও শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিটি কর্তৃপক্ষ সার্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছে।

এদিকে বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় কাপনা নদীতে নৌকা ডুবে নিখোঁজ যুবকের মরদেহ উদ্ধার করাহয় বলে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইএনও) নির্বাহী অফিসার মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান।

মৃত ব্যক্তি হলেন উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের শিব্বির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ সাদাত হোসেন।

ইউএনও বলেন, “সাদাতকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য সিলেটে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। তার পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়া তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।”

সাদাতের বড় ভাই হাকুর বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শওকতুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “সাদাতকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য সিলেটে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় স্থানীয়রা। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *