সিলেটে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নেমে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় নলকূপের পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। অপরিকল্পিতভাবে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তোলার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে গবেষকরা মনে করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার প্রায় সব উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পানির স্তর নেমেছে ৪০ থেকে ৬০ ফুট নিচে। ফলে সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না। আবার পাহাড়-টিলা অধ্যুষিত কিছু এলাকায় নলকূপ স্থাপনই করা যায় না। সিটি করপোরেশনও পারছে না চাহিদামতো পানি সরবরাহ করতে। সিলেট নগরী ও সদর উপজেলার বেশকিছু এলাকায় পানির জন্য রীতিমতো হাহাকার শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাছ লাগানোর পাশাপাশি নদ-নদী, খালগুলো সংস্কার করে পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। পুকুর ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে।
নগর ভবন সূত্রে জানা যায়, নগরীর সাবেক ২৭টি ওয়ার্ডে প্রায় ১৭ হাজার পানির গ্রাহক রয়েছেন। এই ১৭ হাজার গ্রাহককেও নিয়মিত পানি সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো ১৫টি ওয়ার্ড। বর্ধিত ওয়ার্ডে আরো অন্তত অর্ধলাখ খানা রয়েছে। যেগুলো পানি সরবরাহের আওতার বাইরে। বর্ধিত এলাকার অনেক পাড়া-মহল্লায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানি সংকট তীব্র হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের পানি শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী এনামুল হক তাপাদার জানান, বর্তমানে একটি শোধনাগার ও ৪১টি গভীর নলকূপ থেকে পানির সরবরাহ করা হচ্ছে। নগরীতে চার কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। তারা সাধ্যমতো সরবরাহের চেষ্টা করছেন।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেটের তথ্যমতে, সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় পানির স্তর নিম্নমুখী। এর মধ্যে সিলেট নগরীর বিভিন্ন অংশ, সিলেট সদর ও দক্ষিণ সুরমা ও টিলা অধ্যুষিত কানাইঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার দু একটি ইউনিয়ন রয়েছে। অনেক জায়গায় পানির স্তর ৩২-৪০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। যার জন্য সাবমার্সিবল টিউবওয়েল স্থাপন করে দিতে হচ্ছে।
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামে মাটির তলদেশে প্রচুর পাথরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ফলে টিউবওয়েল বসিয়ে সেখানে সুফল মেলে না। তাই যুগ যুগ ধরে এখানে পানির একমাত্র উৎস কুয়া। স্থানীয়ভাবে যাকে ইন্দারা বলা হয়। এর ওপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষের জীবন। নিজপাট ইউনিয়নে রয়েছে নয়টি ওয়ার্ড। গ্রাম রয়েছে ৬৫টি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে সারা দেশেই পানির স্তর নিম্নমুখী। সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমাসহ সব ক’টা উপজেলায় পানির স্তর নিম্নমুখী। তাই এখানে সাবমার্সিবল পাম্প বসানো হচ্ছে। জৈন্তাপুর ও কানাইঘাটের দুই-তিনটি ইউনিয়নে পানির স্তরের সমস্যা নেই, সেখানে মূলত পাথরের জন্য নলকূপ স্থাপন করা যায় না।’
আলমগীর হোসেন আরো জানান, জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টি না হওয়া, খাল, নদী, পুকুর ভরাট হয়ে যাওয়া; সর্বোপরি বাসাবাড়ির কাজের জন্য মাত্রাতিরিক্তভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে এমনটা হচ্ছে। আবার সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টিপাতও কম হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, সিটি করপোরেশন থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। বর্ধিত এলাকায়ও পানি সরবরাহ করা হবে। সিলেট ওয়াসা গঠন করা হয়েছে। শিগগিরই এর কার্যক্রম শুরু হবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমেদের মতে, দিন দিন আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পুকুর, বিল ভরাট হচ্ছে। সেই সঙ্গে নদ-নদী. খাল দখল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া খাদ্য উৎপাদনে যে পানি দরকার তা পুকুর, বিল, নদ-নদী থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য মাত্রাতিরিক্তভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। তাতে প্রতি বছর পানির স্তর নিচে নামছে।
তিনি যোগ করেন, যেসব খাল-বিলের মাধ্যমে পানি ভূগর্ভস্থ হবে, প্লাস্টিক বর্জ্য তাতে নানাভাবে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। এটাও পানির স্তর নিচে নামার অন্যতম কারণ। গাছ লাগানোর পাশাপাশি নদ-নদী, খালগুলো সংস্কার করে পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। পুকুর ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ পাওয়া সম্ভব।
শেয়ার করুন