সোমবার দুপুরে ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সিলেটসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা। ৪ দশমিক ৫ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও সিলেটে।
তাৎক্ষণিভাবে ভূমিম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলা থেকে ১৮ কিমি দূরে বলে জানিয়েছে অ্যান্ড্রয়েড ভূমিকম্প সতর্কতা সিস্টেম।
এরআগে গত ১৪ আগস্টও সিলেটে ভূমিকম্প হয়। সিলেটের ডাউকি চ্যুতি থেকে এই ভূমিকম্পের সৃষ্টি। গত কয়েক বছরে এই চ্যুতিরেখায় কয়েকটি ভূমিকম্প হওয়ায় বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।
এমনিতেই ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোনে অবস্থান সিলেটের। ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম ১৯৯৮-এর জরিপ অনুযায়ী ‘সিলেট অঞ্চল’ ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে সক্রিয় ভূ-কম্পন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।
এদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নীতিমালা না মেনে ভবন নির্মাণসহ নানা কারণে বড় ভূমিকম্প হলে এখানে বড় ধরনের বিপর্যয়েরই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসেন বলেন, ‘ছোট ছোট ভূমিকম্পের পর বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে বিষয়টা উৎপত্তিস্থলের ওপর নির্ভর করে। যদি একই জায়গায় বারবার ভূমিকম্প হয় তাহলে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে।
জানা যায়, বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের আসাম মিলিয়ে ডাউকি চ্যুতি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার বিস্তৃত। ১৮৯৭ সালে ‘ডাউকি ফল্টে’ ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। যাতে ভেঙে পড়ে এই অঞ্চলের বেশির ভাগ বহুতল ভবন।
এদিকে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে দিন দিন বাড়ছে আকাশছোঁয়া ভবন তৈরির প্রতিযোগিতা। ভরাট হচ্ছে জলাধার। কেটে ফেলা হচ্ছে পাহাড় টিলা। এতে বাড়ছে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কাও।
গবেষকদের মতে, সিলেটের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবনই অপরিকল্পিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে সাত বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে অধিকাংশ ভবনই ভেঙে পড়বে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে নগরীর শাহজালাল উপশহর, আখালিয়া, বাগবাড়ী, মদিনা মাকের্ট প্রভৃতি এলাকা। বাণিজ্যিক ভবন ও ইমারতের পাশাপাশি নগরীতে অপরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। গবেষণার তথ্যমতে, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বহু বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে যেগুলো ভূমিকম্পের সময় ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এসব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ধসে পড়লে প্রাণহানি আরও বেড়ে যাবে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ, জাপান ও শ্রীলঙ্কার একটি বিশেষজ্ঞ দল সিলেট নগরীর ছয় হাজার ভবনের ওপর জরিপ চালিয়ে এই গবেষণা রিপোর্ট তৈরি করে। এই গবেষণায় দলে ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের দিক থেকে সিলেট মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও তাৎক্ষণিক ক্ষতি-হ্রাস ও উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য সিলেটে আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি নেই।’ তিনি ভূমিকম্পের ঝুঁকি মাথায় রেখে এখনই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘সিলেটের ৭৪.৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধকভাবে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ৭ মাত্রার ভূমকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।’
ভূমিকম্পবিষয়ক বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে জানা যায়, ভূমিকম্পের মাত্রা অনুসারে বাংলাদেশ তিনটি ভূকম্পন বলয়ে বিভক্ত। এর মধ্যে ১ নম্বর বলয়ে রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৯ বা তার অধিক মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। আর এই ১ নম্বর বলয়েই সিলেটের অবস্থান। এই বলয়ে আরও রয়েছে ময়মনসিংহ ও রংপুর।
অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে ঘনঘন ভূমিকম্পের উৎপত্তি হলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে যদি একই জায়গা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয় তাহলে অব্যশই চিন্তার বিষয়। এ রকম ঘনঘন ভূমিকম্প হলে আমাদের একটু সর্তক থাকতে হবে।
২০২১ ও ২২ সালে কয়েক দফা ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি মোকবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা, সব বহুতল ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষাসহ কিছু উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। কয়েকটি ভবন বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ৩০ মে নগরের ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিসিক। ওই দিনই নগরের সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানশন ও রাজা ম্যানশন নামের সাতটি বিপণিবিতানকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সময়ে নগরের প্রায় ৪২ হাজার বহুতল ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। কিন্তু অর্থসংকটে সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। আর নির্ধারিত ১০ দিন পর কোনো সংস্কার ছাড়াই খুলে দেয়া হয় বন্ধ করা ভবনগুলো। এখনো এগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ১০টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা আমরা দিয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কার করার জন্যও আমরা মালিকপক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তা শুনেননি। আবার ভবনগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতে মামলা করে বসেন।
৪২ হাজার ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা নগরের ৪২ হাজার ভবনে ভূমিকম্পের সহনীয়তা নিয়ে প্রকৌশলগত বিস্তারিত মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। নগরের ৪০-৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করাতে ২৫-৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই খাতে এত বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার মতো তহবিল নেই।
সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান আয়তন ৭৯.৫ কিলোমিটার। ২০২১ সালে সীমানা বর্ধিত করার পূর্ব পর্যন্ত আয়তন ছিল ২৬.৫ বর্গকিলোমিটার। পূর্বের আয়তনের তালিকাভুক্ত হোল্ডিংয়ের সংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার। এর মধ্যে ২ থেকে ২১ তলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে ৪১ হাজার ৯৯৫টি। সীমানা বাড়ানোর পর ভবনের সংখ্যা আর জরিপ করা হয়নি।
শেয়ার করুন