সিলেটে বাসাভাড়ারও চাপ,বাসা ভাড়া নির্ধারণে সিসিকের করণীয় কিছু নেই : প্রধান নির্বাহী

সিলেট

করোনার পর দু’দফা বন্যা। হাওরে ফসলহানি। সবজিও ফলেনি সিলেটে। এরমাঝে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে এলো জ¦ালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি। এমন পরিস্থিতিতে সিলেটে যোগ হয়েছে বাসাভাড়া বৃদ্ধির চাপও। ইতোমধ্যে অনেকে বাসা ভাড়া বাড়িয়েও দিয়েছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, ভাড়া বৃদ্ধি ছাড়া উপায়ও নেই বলছেন বাড়িওয়ালারা।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই কঠিন সময়ে বাসা-বাড়ীর মালিকদের এমন কর্মকাণ্ডে দিশেহারা ভাড়াটিয়ারা। তারা জানান, সিলেটে যারা ভাড়া বাসায় থাকে তাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবার। করোনা পরবর্তীসময়ে তারা বাসাভাড়া দিয়ে সংসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এরমধ্যে ২ দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেটের বিশাল জনগোষ্টী। শেষ সময়ে জ¦ালানী তেলের দামকে কেন্দ্র করে আরেক দফা বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। এই পরিস্থিতিতে বাসাভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে অমানবিক হিসেবে দেখছেন অনেকেই। বাড়িওয়ালাদের ওপর সরকারের কোনো সংস্থার নিয়ন্ত্রণ নেই। অবিলম্বে বাড়ির মালিকদের এই অপতৎপরতা বন্ধ করতে সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়া পরিবার।
সম্প্রতি পাঠানটুলা, সুবিদবাজার, আম্বরখানা, বাগবাড়ী, ভাতালিয়া সহ কয়েকটি এলাকায় বাসাভাড়া বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন একাধিক বাড়ির মালিক। এমন সিদ্ধান্তে হতভম্ব ভাড়াটিয়ারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাড়াটিয়া বলেন, মদীনা মার্কেট এলাকায় ৫ তলা একটি বাসায় ১০ টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাড়িটির সবকটি ফ্ল্যাটে চাকরিজীবী এবং মধ্যবিত্ত লোকজন ভাড়া থাকেন। সম্প্রতি তেলের দাম বাড়ানোর পর হুট করে বাসা বা ফ্ল্যাটভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাড়ি মালিকের এমন কর্মকাণ্ড দেখে সব ভাড়াটিয়া অবাক হয়েছেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর এমনিতেই জীবনযাত্রার ব্যয় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। মাস শেষে ধার করে সংসার চালাতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে বাসাভাড়া বাড়ানো ডাকাতির শামিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বাসার কেয়ারটেকার বলেন, বাসার মালিক লন্ডনে থাকেন। ৫ তলা বাসার ফ্ল্যাটগুলোর আয়তন অনুযায়ী এতদিন ভাড়া কম নেওয়া হতো। ভাড়া বাড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তা করা হয়নি। এখন বাড়ির মালিকের নির্দেশেই ভাড়া বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
নগরীর সুবিদবাজার এলাকার একটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে বাস করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শিমুল। তার বাড়ির মালিক বাসাভাড়া বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, এমনিতেই প্রতি বছর জানুয়ারিতে গড়ে ৫০০ টাকা করে বাসাভাড়া বাড়ান বাড়ির মালিক। এখন শুনছি, তার আগেই বাসাভাড়া বাড়ানো হবে। এ নিয়ে বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়ারাও আতঙ্কে আছেন।

নগরীর পাঠানটুলা এলাকার ৪ তলা বাসার  ৩য় তলায় ভাড়া থাকেন একটি ওষুধ কোম্পানির চাকরিজীবী মুজিবুর রহমান। মাসে সব মিলে বেতন পান ২০ হাজার টাকা। তিনি জানান, তিনি যে বাসায় ভাড়া থাকেন, এটির ভাড়া মাসে ছিল ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সংসার খরচ চলতো। এখন যে হারে খাদ্যের দাম বাড়ছে, ধারদেনা করতে হচ্ছে। তারপরও যদি বাসাভাড়া বাড়ানো হয়, তা হলে সিলেটে পরিবার নিয়ে থাকা সম্ভব হবে না।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছরই বাড়ানো হচ্ছে বাসা ভাড়া। বাসার মালিকরা নিয়ম কানুন কিংবা আইনের তোয়াক্কা না করেই বাসা ভাড়ার মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন। প্রশাসন কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে যেন একেবারেই উদাসীন। সিলেটকে দ্বিতীয় লন্ডন বলা হয়। অথচ মধ্যবিত্তদের অনেকেই এখানে এখনো দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। তাদের অনেকেই জীবিকার সন্ধানে কিংবা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় সন্তানদের পড়াখেলা করানোর জন্য গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসেন। নিজ বাড়ি ঘর-পরিবার পরিজন ছেড়ে বসবাস করতে আসেন শহরে। কিন্তু বাসা ভাড়া পাওয়া প্রায় সময়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়াও নানা সমস্যার সম্মুখিন হতে হয় ভাড়াটিয়াদের। বাসা ভাড়া মিললেও মালিক পক্ষের নিয়ম কানুনের কারনে ভাড়াটিয়াদের নানা রকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালা কর্তৃক নানা ধরনের অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হন। যখন তখন ভাড়া বৃদ্ধি করা, বছর যেতেই না যেতেই ভাসা ভাড়া ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ। ফলে চরম ভোগান্তির শিকার হন ভাড়াটিয়ারা। বর্তমান সময়ে জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উর্ধ্বমূখী, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ঔষুধ সহ বিভিন্ন দ্রব্যমূল্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সিলেটের বাসা বাড়া। মধ্যবিত্ত ছোট-বড় পরিবার মানুষ জন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা দূরহ হয়ে পড়ছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় দ্বিগুন হয়ে দাড়িয়েছে। সিলেট নগরীর প্রতিটি পাড়ায় কম পক্ষে ছোট পরিবার যদি বাসা ভাড়া নিতে চায় তাহলে ৮-১০ হাজার, পরিবারের সদস্য সংখ্যা যদি বেশি হয় তাহলে কোন কথা নাই ১০-১৫ হাজারে মধ্যে বাসা ভাড়া খুজতে হবে। তার মধ্যে নানা জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়।

এছাড়া প্রবাসী মালিকদের বাসা ভাড়া নিতে অনিচ্ছুক অনেকেই। কারণ হিসেবে তারা জানান, প্রবাসে থাকা পরিবারগুলো প্রতিবছরই দেশে আসেন। এক্ষেত্রে তারা আসার ২ মাস আগে মালিক দেশে আসবে তাই বাসা ছাড়তে হবে এমন নোটিশ যেন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেশের শতকরা কত শতাংশ মানুষ ভাড়াটিয়া হিসাবে থাকনে তার কোন সঠিক তথ্য নেই। রাজধানীতে প্রায় -৭০-৮০শতাংশ মানুষ ভাসা ভাড়ায় থাকে। তবে সিলেটে কত শতাংশ মানুষ ভাসা ভাড়ায় থাকে তার কোন নির্দিষ্ট হিসাব না থাকলে ও বিভিন্ন সূত্রে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ মানুষ বাসা ভাড়ায় থাকেন বলে জানা গেছে।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বর্ধিত এলাকা ছাড়া সর্বশেষ হোল্ডিং হিসেব অনুযায়ী নগরীতে নিবন্ধিত বাসা বাড়ীর সংখ্যা ৭৫ হাজার। বর্ধিত এলাকার হিসেব এখনো আসেনি। তবে সিসিকের অন্য একটি সুত্র জানিয়েছে নগরীতে নিবন্ধনের বাইরেও ২০ হাজারের অধিক বাসা বাড়ী রয়েছে। এছাড়া সিসিকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনেকেই বাসার পরিধি বাড়াচ্ছেন। কিন্তু ট্যাক্স কম দেয়ার জন্য তথ্য গোপন করে থাকেন। এ নিয়ে কোন অভিযান এখনো চোখে পড়েনি।

বাসা ভাড়া নির্ধারণ প্রসঙ্গে সিসিকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমান বলেন, নগরীতে বাসা ভাড়া নির্ধারণে সিসিকের কোন কার্যক্রম নেই। তবে কোন ভাড়াটিয়ার অধিকার হরণ করলে বাসা ভাড়া আইনের মামলায় প্রতিকার চাইতে পারেন। এজন্য জেলা জজ আদালতে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন- বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রন আইন ১৯৯১ সালের আইনটি শতকরা ৮০ ভাগ ভাড়াটিয়া জেনেও না জানার ভান করেন। কিছু মালিক একদিকে বাসা ভাড়া বৃদ্ধি করেন অপরদিকে সিটি কর্পোরেশনে ট্যাক্স দেয়ার সময় বাসা ভাড়া কম দেখান। বাসা ভাড়া নিয়ে সরকারী কোন সংস্থার কার্যক্রম না থাকায় ভাড়াটিয়ারা বাসার মালিকদের অনৈতিক সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিচ্ছেন। অনেক ভাড়াটিয়া আইনের ব্যাপারে জানেন না, আবার কেউ জানলেও বাড়তি জামেলা এড়াতে নিরবে সয়ে যান।

তিনি বলেন, বাসা ভাড়া আইনটি সংশোধন করা, বর্তমান সমপযোগী আইন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আইনটির সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে সরকারীভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা সম্ভব। কিছু কিছু বাড়িওয়ালার অমানবিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রচলিত আইনে ভাড়াটিয়ারা প্রতিকার চাইলে কিছুটা হলেও মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হতো।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বাসা ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের করণীয় কিছু নেই। হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ ও আদায়কালে সিসিক বাসা ভাড়ার হিসেব নিয়ে থাকে। তবে অযৌক্তিকভাবে বাসা ভাড়া বাড়ানো কোন অবস্থাতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রচলিত বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রন আইন-১৯৯১ অনুযায়ী ধারা ১০,২৩,২৪, ২৫,২৬ বাড়ি ভাড়ার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

কিন্তু এই আইন অনেক ভাড়াটিয়ারা জানেন না এবং অধিকাংশ বাসার মালিকও জানেন না এবং মানেন না। যেমন: মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ, এক মাসের অধিক অগ্রীম ভাড়া নেওয়া যাবে না, দুই বছরের আগে বাসা বাড়া বাড়ানো যাবে না, দুই বছর পর ভাড়াটিয়াদের সম্মতির ভিত্তিতে বাসা বাড়ানো যেতে পারে, ভাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের আসবাপত্র ক্রয় বা আটক করতে পারবেন না। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ১৮৮২ সনের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৯৭২ সালে চুক্তি আইন অনুযায়ী ভাড়াটিয়ার নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করলে ভাড়াটিয়াকে যখন তখন উচ্ছেদ করা যাবে না। ভাড়া দেয়ার পূর্বে ভাড়াটিয়াদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের উপযোগী করে দেয়া, মেরামত, পানি সরবরাহ করা সহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধার কথা থাকলেও বেশিরভাগ বাসার মালিক তা মানেন না এবং দায়িত্ব পালন করেন না।

শুধ তাই নয় বাসার সামনে খোলা জায়গা বা উঠানেও খেলতে দেন না ভাড়াটিয়াদের শিশুদের। তাদের চিকিৎকারে নাকি তাদের সমস্যা হয়। ভাড়াটিয়াদের কষ্ট, হয়রানি, অভিযোগের শেষ নেই। যখত তখন বাসা ছাড়ার নোটিশ দেন, ইচ্ছমত বাড়া বৃদ্ধি করেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *