সিলেটে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় নেই যথাযথ উদ্যোগ

সিলেট

সিলেট নগরীকে বারবারই ভূমিকম্পের জন্য ‘ডেঞ্জার জোন’ হিসেবে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এর পরও কমেনি অপরিকল্পিত নগরায়ণ। ফলে দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ নগরীর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটের প্রায় ৪২ হাজার ভবনের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে নগরীর ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে।

সর্বশেষ সিলেটে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ছাতকের ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ৬৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ ফারজানা সুলতানা জানিয়েছেন, এর কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সিলেটে মৃদু কম্পন অনুভূত হয়েছে।

মৃদু কম্পনে কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর চেয়ে বেশি ভূমিকম্প হলে তা সহ্য করতে পারবে না সিলেটের বেশির ভাগ ভবন। তখন সৃষ্টি হতে পারে তুরস্ক বা সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি। কিন্তু ঝুঁকি মোকাবেলায় দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপও নেয়নি সিলেট সিটি করপোরেশন। অর্থ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন জরিপ বা পরীক্ষাকাজের উদ্যোগ নিয়েও বারবার পিছু হটেছে সংস্থাটি।

গত কয়েক বছরে সংঘটিত ভূমিকম্পের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অন্তত ২০টির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভেতরে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এর ১১টি সিলেট অঞ্চলে। সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে প্রায় ৪২ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও শেষ পর্যন্ত ভাঙা যায়নি। ২০২১ ও ২২ সালে কয়েক দফা ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবেলায় কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। ভূমিকম্পের ক্ষতি কমাতে ২০২১ সালের মে মাসে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়া সিলেটের ছয়টি বিপণিবিতান বন্ধ করে দিয়েছিল সিসিক। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর সেগুলোও এখন চলছে পুরোদমে।

সিলেট ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা মনে করেন, সিলেটে ভূমিকম্প হলে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা কঠিন হবে। তিনি বলেন, ‘সিলেটের অলিগলির রাস্তা খুবই সরু। ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। গত বুধবার নগরীর গোলাপবাগে একটি বাসায় আগুন ধরে যায়। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। শুধু রাস্তা সরু থাকার কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়েও ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। তাই সিটি করপোরেশনকে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই উদ্যোগী হতে হবে।’

এ বিষয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘২০২১ সালের মে ও জুনে পরপর ছয় দফা ভূমিকম্পের পর বড় ভূমিকম্পে ক্ষতি কমিয়ে আনতে নগরীর সব বহুতল ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতা পরীক্ষা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। ওই সময় বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার এলাকার কিছু ভবন পরীক্ষা করা হয়। পরে আর এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘সিলেট নগরীর ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। ফলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে। সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন যে ভেঙে ফেলতে হবে তা নয়, ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন ভেঙে না ফেলে রেক্টোফিটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।’

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ৩০ মে নগরের ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিসিক। ওইদিনই নগরীর সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানশন ও রাজা ম্যানশন নামের সাতটি বিপণিবিতানকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর অনেক ব্যবসায়ী আন্দোলনের ঘোষণা দেন। কেউ কেউ আবার আদালতেও যান।’

নূর আজিজ মনে করেন, ভূমিকম্প-পরবর্তী করণীয় ও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে নগরবাসীরও সচেতন ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু সেটিও তারা করছেন না।

নগরীর ৪২ হাজার ভবনে ভূমিকম্পের সহনশীলতা নিয়ে প্রকৌশলগত মূল্যায়নের উদ্যোগ প্রসঙ্গে নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের পক্ষে এ খাতে এত বিশাল অংকের অর্থ খরচ করার মতো তহবিল নেই। চারতলা একটি ভবন মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন ৪০-৫০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে নগরীর ৪০-৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করাতে ২৫-৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন। একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তবে তহবিলের অভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।’

এ বিষয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ভূমিকম্পের সহনশীলতা নিয়ে প্রকৌশলগত মূল্যায়নের বিষয়টি আমার মাথায় এসেছিল। এরপর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ নিয়েছি। তবে এ ভবনগুলো প্রকৌশলগত মূল্যায়নের জন্য ভবন মালিকরা টাকা দেয়ার কথা। কিন্তু মালিকরা তাতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এছাড়া বিশাল তহবিল প্রয়োজন, সেটি সিটি করপোরেশন সংকুলান করতে পারছে না, যার কারণে সফল হওয়া যায়নি।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *