একেক সময় এক এক মৌসুম আসে। এসব মৌসুমের অপেক্ষায় থাকেন সুযোগ সন্ধানীরা। এবার তাদের সামনে এসেছে নতুন সুযোগ। গণঅভ্যুত্থানের পর সিলেটে একদল লোক মেতে উঠেছেন মামলা বাণিজ্যে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মামলা বাণিজ্যের হোতাদের ভয়ে আছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ।
মামলা বাণিজ্যে এই অসাধুচক্র টাকার পাহাড় গড়ার পাশাপাশি হয়ে উঠেছেন আতঙ্কের কারণ। কেউ কেউ মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন আবার কেউ টাকার বিনিময়ে কাটাচ্ছেন মামলা থেকে নাম। এরকমই চলছে বর্তমান সময়ের আলোচিত মামলা বাণিজ্যের মৌসুম।
একাত্তরের কথা’র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গণঅভ্যুত্থান বা জুলাই বিপ্লবের পর থেকে দেশের অন্যান্যস্থানের মতো সিলেটেও বেড়ে গেছে মামলা দায়েরের সংখ্যা। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে যে যার মতো পারছেন বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করছেন থানায় কিংবা আদালতে। এসব মামলার অভিযোগে অপরাধীদের সাথে সাথে জড়িত করা হচ্ছে নিরীহ ব্যক্তিদেরও।
জানা গেছে, কিছু থানার হর্তা-কর্তা প্রভাবশালীদের সাথে মিলে জড়িয়েছেন মামলা বাণিজ্যে। আবার টাকা খেয়ে অনেক মামলার বাদী আদালতে বিবাদীর পক্ষে নোটারি পাবলিক ও হলফনামা দিয়ে বলেছেন মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে। অনেক বাদী থানায় গিয়ে লিখিতভাবে বিবাদীর ব্যাপারে অনাপত্তি জানাচ্ছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বাদী বলছেন আসামি না ধরতে- এমন ঘটনাও শুনা যাচ্ছে ভুক্তভোগীদের মুখে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেটের খাদিম নগর ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য জানান তাকেও আসামি করা হয় একটি মামলায়। পরে ১ লাখ টাকা দিয়ে মামলা থেকে নিজের নাম কাটিয়েছেন। গত প্রতিবেদনে লিখা জগন্নাথপুরের সাকিবের কাছেও টাকা চাওয়া হচ্ছে। সাকিব জানিয়েছেন, টাকা না দিলে তার নামে আরো মামলা হতে পারে কিংবা এমনও হতে পারে অন্য নাম খুঁজে বের করে তাতে তাকে আটকে দেয়া হবে।
সিলেটের আল আমিনের স্ত্রী কুলসুম সাভারের আশুলিয়া থানায় জীবিত স্বামীকে মৃত দেখিয়ে করা মামলায় বৃহস্পতিবার রাতে মামলার করানোর নেপথ্যে থাকা শফিকুর রহমান ও রুহুল আমিনসহ আটক হোন পুলিশের হাতে। পরে জানা যায়, চাকরির প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে বাদী কুলসুম আক্তারকে দিয়ে এই মামলা করিয়েছে শফিকুর রহমান ও রুহুল আমিন। এরকম আরো ঘটনা ঘটছে অহরহ। এই সুযোগটা আরো কাজে লাগাচ্ছেন সুযোগ সন্ধানী কিছু ‘ভুয়া সমন্বয়ক’। নিজেকে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে অনেক কাণ্ড কাহিনি ঘটাচ্ছেন বিভিন্ন এলাকায়। কুলসুমের করা মামলায় ৫৭ নম্বর আসামি লিয়াকত দেওয়ান নামক এক ব্যক্তি আশুলিয়া থানায় উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘এই মামলা করানোর অন্যতম নায়ক রুহুলের ছেলে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে একজনের মাধ্যমে জনপ্রতি ২ লাখ টাকা চায়। পরে আমরা ১১ জন মিলে ১৭ লাখ টাকা দিয়েছি।’ অন্য একটি মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মঙ্গলবার মৌলভীবাজারে ছাত্র আন্দোলনের দুই কর্মীকে অব্যাহতি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মৌলভীবাজার জেলা।
গত ৪ আগস্ট গোলাপগঞ্জে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ঘোষগাঁওয়ের মোবারক আলীর ছেলে গৌছ উদ্দিন। এ ঘটনায় ২০ আগস্ট গৌছ উদ্দিনের ভাতিজা রেজাউল করিম বাদী হয়ে থানায় মামলা হয়। ফেসবুকের মাধ্যমে রেজাউল যখন জানতে পারেন এই মামলার বাদী তিনি তখনই মামলা দায়েরের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন তার স্বাক্ষর জাল করে থানায় মামলা হয়েছে।
নিহতের পরিবারকে সাহায্য দেওয়ার নামেও করা হচ্ছে প্রতারণা। গত ৫ আগস্ট বিয়ানীবাজার উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন ভবনে হামলার ঘটনায় গুলিবিদ্ধি হয়ে প্রাণ হারান তারেকসহ তিনজন। এ দিনের ঘটনায়ও ২০ আগস্ট থানায় একটি মামলা হয়। এতে মামলার বাদী নিহত তারেকের মা ইনারুন নেছা বলেন, সাহায্য দেয়ার নাম করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে মামলা করা হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেছেন। মামলার আসামির তালিকায় আছেন বিদেশে অবস্থান করা ৯ জন। আছেন স্থানীয় সাংবাদিকও।
মামলা থেকে বাদ পড়ছেননা সাংবাদিকরাও। ৫ আগস্ট সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্পের সামনে আনন্দ মিছিলে হামলা ও গুলি চালিয়ে বিলালের ছেলে সুমন মিয়াকে হত্যার অভিযোগে গত ২৭ আগস্ট গোয়াইনঘাটের মাতুরতল ফেনাই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুন নুর বিলালের নাম ব্যবহার করে ৬৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা হয়েছে। অথচ এ মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না বাদী বিলাল। সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘটনা ঘটলেও এই মামলায় আসামি করা হয়েছে সাংবাদিক দেবাশীষ দেবুকে। এরআগে সাংবাদিক সাদিকুর রহমান সাকী, ওলিউর রহমানসহ অনেককেই মামলায় জড়ানো হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলা কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় মামলার আসামি হয়েছেন তরুণ ব্যবসায়ী সায়েদুল আরেফিন রিয়াদ। প্রতিবেশীর করা মামলায় গত ২৭ জুন আদালতের নির্দেশে হাজতে প্রেরণ করা হয় রিয়াদকে। ৪ আগস্ট জামিনে মুক্তি পান তিনি। কিন্তু গত ৩ আগস্ট বিকেলে চৌহাট্টা পয়েন্টে ছাত্রজনতার উপর হামলার ঘটনায় রাজন মিয়া নামক একব্যক্তির মামলায় ১৩নং আসামি করা হয় তাকে। একই সাথে হবিগঞ্জ শহরে থেকেও একই মামলার আসামি হন তার চাচা লোকমান চৌধুরী।
সিলেট মহানগর পুলিশসূত্রে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত মহানগরীর বিভিন্ন থানায় প্রায় ৭৮টি মামলা হয়েছে। ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সাড়ে ৬ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামিও আছেন অন্তত ২৫ থেকে ৩০ হাজার। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে কোতোয়ালি থানায়; ৫০টি।
মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, মামলা যারা করতে আসছেন আইন অনুযায়ী মামলা নেওয়া হচ্ছে। তবে যদি সন্দেহ হয় তাহলে প্রত্যেক থানার ওসি তদন্ত করে মামলা নিচ্ছেন। এবং আসামি ধরার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
সচেতন মহল সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ঢালাওভাবে দেখছি চতুর্দিকে মামলার হিড়িক পড়েছে। পত্রপত্রিকায় দেখছি বাদি আসামি কেউ কাউকে চিনেননা। এভাবে যেন আর কোনো নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করা হয় আমি এমনটাই চাই।
সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার (এসএমপি) মো. রেজাউল করিম বলেন, ইদানীং আমাদের কাছে কেউ মামলা নিয়ে আসলে আগে আমরা যাচাই করছি। যাচাই ছাড়া কোনো মামলা নিচ্ছি না। আসামি ধরার ক্ষেত্রেও আমরা খুবই সতর্কতা অবলম্বন করছি যাতে কোনো নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হোন। মনিটরিং সেলও গঠন করেছি যাতে নির্দোষ কোনো মানুষ আসামি না হোন বা গ্রেপ্তার না হন।
সম্প্রতি সিলেট সফরকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউসে প্রশাসনিক ও বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কিত এক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, মিথ্যা মামলা বেড়ে গেছে। কোনো অবস্থায় মিথ্যা মামলা নেওয়া যাবে না। কেউ যদি মিথ্যা মামলা করে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। মিথ্যা মামলা দিয়ে চাঁদাবাজি, হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
শেয়ার করুন