সিলেটে ‘মুক্ত’ঘোষণার পরও বন্ধ হচ্ছে না বাল্যবিবাহ

সিলেট

সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর এক কিশোরীর বাল্য বিবাহ আয়োজন করেন তার পরিবার। এমন খবর পেয়ে সেখানে যান মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সিলেটের কর্মকর্তাবৃন্দ। ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা বাল্য বিবাহের খবরের সত্যতা পান। পরে অভিভাবকদের মুচলেকা নিয়ে বিবাহ বন্ধ করে আসেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

একদিকে আইনত নিষিদ্ধ অপরদিকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা তারপরও সিলেটে হচ্ছে বাল্যবিয়ে। কাগজে কলমে বাল্যবিবাহ মুক্ত হলেও সিলেটের বাস্তব চিত্র ভিন্ন। হাওর ও চা বাগান অধ্যুষিত এলাকা হওয়া সিলেট বিভাগে বিগতসময়ও বাল্যবিবাহের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল। এখনো সিলেটে আছে বাল্যবিবাহের প্রভাব তবে আগের চেয়ে কিছুটা কম।  সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২–এর তথ্য অনুযায়ী- সিলেটে ১৮ বছরের আগে বিয়ে হচ্ছে ২৩.২% নারীর ও ১৬ বছরের আগে বিয়ে হচ্ছে ৯.২% নারীর। যা দেশের অন্য বিভাগের তুলনায় সর্বনিম্ন।

সিলেটকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করায় এখানে নিয়মিত বাল্যবিবাহ হলেও সেটা মানতে নারাজ এই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বশীলরা। তাদের ভাষ্যমতে সিলেট বাল্যবিবাহ হচ্ছে না, তবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হচ্ছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সিলেটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুন মাস থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সিলেট জেলায় মাত্র ৩৫টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে। তবে বাস্তবচিত্র এর উল্টো। কারণ মাঠ পর্যায়ে বাল্য বিবাহের তথ্য সরকারি কোনো সংস্থাই রাখে না। সরকারিভাবে শুধু সেই বাল্যবিবাহগুলোই প্রতিরোধ করা হয় যেগুলো খবর বা অভিযোগ জানানো হয়। কিন্তু এর বাইরেও গোপনে অনেক বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়। এসব বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করতে মাঝে মাঝে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সহযোগিতা করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়,  হাওর ও চা বাগান অধ্যুষিত এলাকা হওয়া সিলেটে আগে থেকেই কম বয়সে মেয়েদের বিয়ের প্রচলন ছিল। তবে বর্তমানে বাল্যবিবাহ আইনের কঠোরতা  ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিলেট শহর এবং হাওর এলাকায় বাল্য বিবাহ অনেকাংশে কম। তবে চা বাগান এলাকায় এখনো বাল্যবিয়ের বেশ প্রভাব রয়েছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সিলেটের দেওয়া তথ্য মতে, দেশের ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৮টি চা বাগান সিলেট বিভাগে পড়েছে। এই চা বাগানে বাল্যবিবাহের হার ৪৬%। যেহেতু চা বাগানগুলো সিলেট বিভাগে পড়েছে সেই অনুপাতে এখানে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বাড়ে। এছাড়াও শহর, গ্রাম বা হাওরাঞ্চলে অনুষ্ঠিত বাল্যবিয়ে তাৎক্ষনিক প্রশাসনকতৃক বন্ধ করা হলেও কিছুদিন পর অন্য এলাকায় গিয়ে বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করা হয়। অনেক পরিবার আইনের চোখ ফাঁকি দিতে ছেলে-মেয়েকে প্রাপ্তবয়স্ক প্রমাণ করার জন্য ভুয়া জন্ম নিবন্ধন, অবৈধ সনদ তৈরি করে বিয়ে সম্পন্ন করেন।

এ ব্যাপারে সিলেট মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শাহিনা আক্তার বলেন, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ছেলে ২১ ও মেয়ে ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ বলে গণ্য হবে। ২০১৬ সালে সিলেটকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করা হলেও এর আগ থেকেই আমরা বাল্য বিবাহ রোধে কাজ করেছি। তবে ২০১৬ সালে পর থেকে আমরা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিশেষ কিছু কার্যক্রম হতে নেই। যেমন সোশ্যাল প্রটেকশন গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। ১০৯ হেল্প লাইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের প্রস্তুতি কোথাও নেয়া হলে আমরা সাথে সাথে সেটা বন্ধ করেছি। আমাদের ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কমিটিকে কার্যকর করা হয়েছে। জিও এনজিও, সুশীল সমাজ প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কাজী, ইমাম ছাত্র, শিক্ষকগণের সমন্বয়ে উঠান বৈঠক, কমিউনিটি সভা, স্কুল ক্যাম্পেইন করে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে।

তিনি বলেন, এতসব পদক্ষেপের পরও অনেক অভিভাবক গোপনে ছেলে মেয়েদের বাল্য বিবাহ দেন। অনেক জায়গায় এমনও শুনেছি আমরা বাল্যবিয়ে বন্ধ করার পর আবার তারা অন্যত্র গিয়ে বিয়ের আয়োজন করেছেন। তবে সিলেটে এখন  বাল্য বিবাহ আগের তুলনায় অনেক কম।

শাহিনা আক্তার বলেন, দেশের অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সিলেট বিভাগরে বাল্য বিবাহের হার প্রায় অর্ধ শতাংশ কম। কিন্তু সিলেটে বাল্যবিবাহের হার বেশি হওয়ার কারণ চা বাগান। ১৬২ টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৮ টি চা বাগান সিলেট বিভাগে। সেখানে বাল্য বিবাহের হার ৪৬%। আমরা চা বাগান এলাকাতেও বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করছি। কিন্তু চা বাগানে যারা থাকেন তাদের সংস্কৃতি, থাকার পরিবেশ ভিন্ন। তাই অন্যান্য এলাকার মত এখানে সচেতনতা মূলক কাজ করাটা একটু কষ্টসাধ্য।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *