সিলেটে শৃঙ্খলা ভঙ্গে ‘পুলিশ’

সিলেট

অপরাধকে সমাজ থেকে নির্মূল করতে আইন সহায়তাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের ভূমিকা অপরিহার্য। পুলিশ কথাটির অর্থ সাহায্যকারী। সমাজে নিরীহ জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পরিচিত পুলিশের হাতে ন্যস্ত। পুলিশ তৎপর হলে অপরাধীচক্র সতর্কতা অবলম্বন করে সাবধান হয়। কিন্তু পুলিশ যদি অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে তবে অপরাধ দমন তো দূরের কথা, তা আরও বিস্তার লাভ করে।তেমনি এবার সিলেটে পুলিশের বিরুদ্ধে উঠছে শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও নানা অপরাধে জড়ানোর অভিযোগ। তিন ঘটনায় শাস্তিরমুখে পড়েছেন সাত পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে ৫জন হচ্ছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এবং দুজন হচ্ছেন জেলা পুলিশের সদস্য।

সম্প্রতি পুলিশের কয়েকটি ঘটনায় সিলেটজুড়েই চলছে সমালোচনার ঝড়।কখনো কাউকে চাঁদা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা, কখনো চাঁদাবাজি।তাছাড়াও রয়েছে নিজেদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাভঙ্গ।এসব বিষয় নিয়ে বেশ কঠোর উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন,অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এক্ষেত্রে অপরাধী পুলিশ সদস্য হলেও তারা কোনো ধরনের ছাড় পাবে না। আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।

জানা যায়, ২০২০ সালের শেষ দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে রায়হান আহমদকে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনায় বিক্ষোভে উত্তাল ছিল পুরো সিলেট। সমালোচনার মুখে পড়ে মেট্রোপলিটন পুলিশ। হত্যার প্রতিবাদে প্রতিদিন মিছিল, রাস্তা অবরোধ, পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাওসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। এ অবস্থায় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেয়া হয় তৎকালীন পুলিশ কমিশনারকে।

সূত্র জানায়, গত ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দফতরের পিআইও শাখায় কর্মরত পরিদর্শক আবু সায়েদের ছেলে সিলেট মহানগরীর মেজরটিলার বাসিন্দা সাইফুর রহমান আসাদ (১৮) তার এক বন্ধুকে নিয়ে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে বেড়াতে যান। এ সময় এসএমপি পুলিশ লাইনসের তিন পুলিশ সদস্য আসাদ ও তার বন্ধুকে জাপটে ধরেন। তাদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে পুলিশ সদস্যরা দাবি করেন ইয়াবা ট্যাবলেট পেয়েছেন। কিন্তু আসাদ তার ব্যাগে ইয়াবা থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে এর প্রতিবাদ করে। আসাদ নিজেকে পুলিশ পরিদর্শকের  ছেলে পরিচয়ও দেয়। সে ফোনে বিষয়টি তার বাবাকেও অবগত করে। আসাদের বাবা আবু সায়েদ ফোনে বিষয়টি মহানগর পুলিশের কর্মকর্তাদের জানালে পুলিশ গিয়ে আসাদ ও তার বন্ধুকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে আসে। রাতে তাদের মুচলেখা রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ঘটনাটি এসএমপি কমিশনার মো.নিশারুল আরিফ জানতে পেরে পুলিশ লাইনসের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ফোর্স) সালেহ আহমদকে তদন্তের দায়িত্ব দেন।তদন্ত শেষে গত ২৪ নভেম্বর কমিশনার বরাবরে লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্তে তিন কনস্টেবলের বিরুদ্ধে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টার সত্যতা পাওয়া যায়।পরে পুলিশের অভিযুক্ত তিন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন- কনস্টেবল মো.ঝুনু হোসেন জয়, ইমরান মিয়া ও মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর সিলেট মহানগর পুলিশ লাইনসে দুই পুলিশ সদস্যের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে।ওইদিন নায়েক পদমর্যাদার এক পুলিশ শটগান দিয়ে আঘাত করে সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার এক সদস্যের মাথা ফাটিয়ে দেন। ঘটনার পরদিন দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

তারা দুজন হলেন- এএসআই মো. রুবেল মিয়া ও নায়েক প্রণজিত।

এদিকে, গত শুক্রবার পাথর ও বালুবাহী ট্রলি আটকে চাঁদাবাজির অভিযোগে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির দুই পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে সিলেট পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত (ক্লোজড) করা হয়েছে।

শুক্রবার রাতে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পাওয়া) শাহরিয়ার বিন সালেহ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে তাঁদের পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়।

পুলিশ সদস্যরা হলেন ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মো.সুমন মিয়া ও মো.শাহরিয়ার হোসাইন। তাদের বিরুদ্ধে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কলাবাড়ি এলাকায় পাথর ও বালুবাহী ট্রলি আটকে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছিলেন এলাকাবাসী।

জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ থানার ভোলাগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) মো.শাহাব উদ্দিন খান গত ২৪ ডিসেম্বর ওই দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।

জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন,ওই দুই পুলিশ সদস্য তাকে না জানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতেন। বারবার তাদের সতর্ক করার পরও তারা চেইন অব কমান্ড মানেননি।

সিলেটের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (কোম্পানীগঞ্জ-গোয়াইনঘাট সার্কেল) প্রভাস কুমার সিংহ গণমাধ্যমকে জানান , মূলত চেইন অব কমান্ড ভাঙার অভিযোগে ওই দুই পুলিশ সদস্যকে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। নির্দিষ্ট জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়ার অভিযোগ আছে।এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে বালু ও পাথরবাহী ট্রলি আটকে চাঁদাবাজির অভিযোগও আছে। বিষয়টি পরবর্তী সময়ে তদন্ত করে দেখা হবে।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো.নিশারুল আরিফ জানান, শাহজালাল মাজার এলাকার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তদন্তও চলছে। ঘটনার সময় ইয়াবা ঠিকই পাওয়া গেছে। কিন্তু ইয়াবাগুলো কার কাছ থেকে পাওয়া গেছে তা নির্দিষ্ট হয়নি। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশ লাইনসে মারামারির ঘটনায়ও বিভাগীয় মামলা হয়েছে জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্ত শুরু হয়েছে।সিলেট মহানগর পুলিশ কোনো অপরাধীকে ছাড় দেয় না। অপরাধী পুলিশ সদস্য হলেও তারা কোনো ধরনের ছাড় পাবে না। আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *