সিলেটে সব ডাকঘরে ডিজিটাল সেবা

সিলেট

বর্তমান সরকারের স্বপ্ন ও প্রত্যয় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে এখন ব্যাপক  সহযোগিতা করছে ডাকঘরের ডিজিটাল সেবা।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ডমেস্টিক মেইল সফটওয়্যারের (ডিএমএস) মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে সিলেট বিভাগের সকল ডাকঘরে এবার চালু হয়েছে পস মেশিনের মাধ্যমে চিঠি, ডকুমেন্ট ও পার্সেল ইস্যু এবং বিলি। ফলে প্রেরক এবং প্রাপক এখন উভয়েই চিঠি, ডকুমেন্ট কিংবা পার্সেলটির অবস্থান যে কোনো সময় জানতে পারছেন। এতে ডাকঘরগুলোতে কাজে এসেছে গতি, পাশাপাশি সেবা ডিজিটাল হওয়ায় সাধারণ মানুষ হচ্ছেন উপকৃত এবং তারা ফের হচ্ছেন ডাকঘরমুখী।

এদিকে, সেবা ডিজিটাল হলেও সেবাগ্রহীতাদের খরচ বাড়েনি, বরং কমেছে। ফলে চিঠি, ডকুমেন্ট কিংবা পার্সেল আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যবস্থা বা কুরিয়ার সার্ভিস বাদ দিয়ে ডাকঘরের দিকে ঝুঁকছেন মানুষ। এতে আয় বাড়ার বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সরকারের।

সিলেট বিভাগীয় প্রধান ডাকঘর সূত্রে জানা গেছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে সিলেট বিভাগের চারটি ডিভিশনের মোট সাড়ে ৪শ ডাকঘরে পস মেশনি ব্যবহার করে ডিএমএস’র মাধ্যমে চিঠি, ডকুমেন্ট ও পার্সেল ইস্যু এবং বিলি শুরু হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম ধাপে সিলেট প্রধান ডাকঘর, উপজেলা ডাকঘর ও সাব-অফিসগুলোতে এ সেবা শুরু হয়। তবে চলতি মাসের শুরুতে বিভাগের সকল ডাকঘরেই এমন সেবা প্রদান শুরু হয়েছে। ফলে এবার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীও পাচ্ছেন ডাকঘরের ডিজিটাল সেবা।

এ সেবার মাধ্যমে প্রেরক এবং প্রাপক ডাকঘরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ঢুকে সহজেই জানতে পারছেন তাঁর চিঠি, ডকুমেন্ট বা পার্সেলের অবস্থান। প্রেরিত জিনিসটি প্রাপকের কাছে পৌঁছে গেলেই মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে  প্রেরক জানতে পারছেন বিষয়টি। এর আগে ইস্যুর সময় প্রাপকও জানতে পারছেন- তার নামে একটি চিঠি, ডকুমেন্ট ও পার্সেল ইস্যু কোন জায়গা থেকে কোন দিন এমনকি কে কখন পাঠিয়েছেন। ফলে শহর থেকে গ্রাম- সবখানেই এখন ডাকঘরে বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার এই সময়ে ডাকবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিজেদের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে দিচ্ছেন নিজেদের। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের গড়ে তুলেছেন প্রযুক্তিগত দক্ষ জনশক্তিরূপে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, আগে প্রতিটি ডাকঘরে কেউ রেজিস্ট্রিপত্র, ডকুমেন্ট বা পার্সেল প্রেরণ করতে আসলে ম্যানুয়ালি অর্থাৎ রেজিস্টার্ড জার্নালে (খাতায়) টাকার পরিমাণ উল্লেখসহ সকল তথ্য লিপিবদ্ধ করে একটি স্লিপ বা রশিদ সেবাগ্রহীতাকে দেওয়া হতো। আর চিঠি, ডকুমেন্টে বা পার্সেলের উপরে রেজিস্টার্ড জার্নালে থাকা রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি লিখে দিতে হতো। তবে এখন আর তেমনটি করতে হবে না। এখন পস মেশিন ব্যবহার করে ডমেস্টিক মেইল সফটওয়্যারের (ডিএমএস) মাধ্যমে চিঠি, ডকুমেন্টে বা পার্সেল ইস্যু করেন সংশ্লিষ্ট ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার (পিএম) বা এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল এজেন্ট (ইডিএ)। এসময় প্রেরিত জিনিসটির উপরে ডাকবিভাগের নিজস্ব বারকোড সেঁটে দেওয়া হয়। সেই বারকোড স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগৃহীত হয়ে যায়  ডিএমএস-এ। ফলে প্রেরক বা প্রাপক যে কোনো সময় ডাকঘরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ঢুকে সহজেই জানতে পারছেন তাঁর চিঠি, ডকুমেন্ট বা পার্সেলের অবস্থান।

এছাড়াও ইস্যুর সময় প্রেরক ও প্রাপকের মোবাইল নাম্বার দেওয়া হলে সঙ্গে সঙ্গে দুজনের মোবাইল ফোনেই মেসেজের মাধ্যমে চলে যাবে পাঠানো বা পৌঁছার তথ্যটি। সব শেষে সেবাগ্রহীতাকে পস মেশিন থেকে প্রিন্ট করা একটি স্লিপ দেওয়া হবে ইস্যু বা বিলিকৃত ডাকঘর থেকে।

এদিকে, প্রেরিত চিঠি, ডকুমেন্টে বা পার্সেলে নির্দিষ্ট ডাকঘরে যাওয়ার পর আগে ব্রাঞ্চ অফিস বা সাব-অফিস জার্নালে (রিসিভ খাতায়) লিখে রাখা হতো সকল তথ্য। এবার শুধু পস মেশিন দিয়ে বারকোড স্ক্যান করলেই সব তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগৃহীত হয়ে যায় ডিএমএস-এ। পরবর্তীতে যে কোনো সময় প্রেরক এবং প্রাপক ডাকঘরের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ঢুকেও জানতে পারবেন এ বিষয়ক তথ্য। এছাড়াও প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট ডাক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরবর্তীতে এসব তথ্য ওয়েবসাইট থেকে খুঁজে নিতে পারবেন।

অপরদিকে, সেবা ডিজিটাল হলেও চিঠি, ডকুমেন্ট বা পার্সেল প্রেরণের ক্ষেত্রে ডাকঘরে এখন আগের চাইতে খরচ হয় কম। আগের ফি থেকে ২০-২৫% কমিয়েছে ডাকবিভাগ। এতে সেবাগ্রহীতারা কুরিয়ার সার্ভিসের চাইতে ডাকঘরে সুবিধা পাচ্ছেন আরও বেশি।

বুধবার (১০ আগস্ট) সিলেট প্রধান ডাকঘরে একটি জরুরি রেজিস্ট্রিপত্র প্রেরণ করতে আসা সিলেট নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা কলেজছাত্র মিজানুর রহমান সিলেটভিউ-কে বলেন- ‘আমি স্টুডেন্ট। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে চাকরির আবেদন পাঠাই। এবারও তেমন একটি আবদেন পাঠাতে পোস্ট অফিসে এসেছি। তবে এখন দেখছি সবকিছু আধুনিক হয়ে গেছে। পস মেশিনের মাধ্যমে চিঠি ইস্যু করা হচ্ছে। চিঠি ইস্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি মেসেজও আমার মোবাইল ফোনে এসে গেছে। বিষয়টি খুব ভালো। এমন সেবা অব্যাহত থাকলে ডাকঘরে ফের সুদিন ফিরবে বলে মনে করি। গ্রামাঞ্চলের পোস্ট অফিসগুলোতে তো আগের মতো মানুষের আনাগোনা নেই। তবে ডিজিটাল সেবা শুরু হওয়ায় গ্রামীণ জনপদের মানুষ ফের ডাকঘরমুখী হবেন বলে আশা করছি।’

দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ডাকঘরে একটি পার্সেল প্রেরণ করতে আসা মাসুদ আহমদ নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী সিলেটভিউকে বলেন- ‘আমি অনলাইনে ব্যবসা করি। আমার হাতে তৈরি বিভিন্ন জিনিস অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করি। আগে আধা কেজি ওজনের যে পার্সেল যে টাকায় পাঠাতে পারতাম, এখন তা থেকে ২০% কম টাকায় পাঠাতে পারছি সেই পার্সেল। আর পার্সেলটি কোথায় আছে তা আমি যে কোনো সময় জানতে পারছি এবং প্রাপকের হাতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আমি মোবাইল ফোনে মেসেজও পাচ্ছি। ডাকঘরের এমন সেবায় আমরা সাধারণ মানুষ অনেক উপকৃত হচ্ছি।’

ডাকঘরের ডিজিটাল সেবার বিষয়ে সিলেট প্রধান ডাকঘরের পোস্ট অফিস সুপার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মলয় কান্তি সরকার সিলেটভিউকে বলেন- ‘গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সিলেট বিভাগে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রথমে বিভাগীয় প্রধান ডাকঘর, উপজেলা ডাকঘর ও সাব-পোস্ট অফিসগুলোতে এ সেবা চালু হয়। ধাপে ধাপে এখন সব ডাকঘরেই ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পস মেশিন ব্যবহার করে ডিএমএস’র মাধ্যমে যে চিঠিটি প্রেরক প্রেরণ করেন সেই চিঠির সকল তথ্য ডাকবিভাগের নিজস্ব ওয়েবসাইটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগৃহীত হয়ে যায়। পরবর্তীতে যে কোনো সময় প্রেরক বা প্রাপক ওই চিঠির তথ্য বা অবস্থান ওয়েবসাইট থেকে জানতে পারেন। এছাড়াও চিঠি, ডকুমেন্ট বা পার্সেল প্রেরণের খরচ আগের চাইতে কমিয়ে দিয়েছে ডাক বিভাগ। মানুষ যাতে সহজে এ সেবাটি পায় সে লক্ষ্যেই এমনটি করা হয়েছে।’

সিলেট প্রধান ডাকঘরের সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল (এপিএমজি) সুজিত চক্রবর্তী সিলেটভিউকে বলেন- ‘বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার ছিলো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই গত বছরের শেষের দিক থেকে ডাকঘরে চিঠি, ডকুমেন্ট বা পার্সেল প্রেরণের ক্ষেত্রে ডিএমএস বা সফটওয়্যার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে এখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও ডাকঘরের মাধ্যমে সরকার প্রতিশ্রুত ডিজিটাল সেবা পাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা সিলেট প্রধান ডাকঘর, প্রতিটি উপজেলা, সাব ও শাখা ডাকঘরের সংশ্লিষ্ট কর্মতর্কা-কর্মচারীদের পস মেশিন ব্যবহারসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতাদের এখন যথাযথভাবে সেবা দিতে পারছেন ডাক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখন শুধু পস মেশিনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রিপত্রগুলো ইস্যু করা হচ্ছে। পরবর্তীতে সাধারণ চিঠিগুলোও (অর্ডিনারি) এ মেশিনের মাধ্যমে ইস্যু করা হবে।’

সুজিত চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘মানুষ এখন আর আগের মতো কুরিয়ার সার্ভিসমুখী নয়, ডাকঘরমুখী। ডাকঘরের ডিজিটাল সেবায় মানুষ খুই উপকৃত হচ্ছেন। এ সেবা চালু করায় আমরা মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। ডাকঘরে আগের চাইতে চিঠি, ডকুমেন্ট বা পার্সেল আদান-প্রদান বেড়ে গেছে। ফলে সরকারেরও বাড়ছে আয়।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *