২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা থেকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নাগরিক রাকিব (ছদ্মনাম)। দীর্ঘ যাত্রায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, তুরস্ক হয়ে একই বছরের নভেম্বর মাসে গ্রিসে এস পৌঁছান তিনি। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন দীর্ঘ যাত্রাপথের দুঃসহ স্মৃতি ও দুর্দশার কথা।
ভূমধ্যসাগর উপকূলবর্তী দেশ লিবিয়া থেকে নৌকা যোগে এবং বলকান রুট হয়ে হাজারো বাংলাদেশি অভিবাসীদের ইউরোপ অভিমুখে যাত্রার কথা আমাদের সবার জানা। এছাড়া আলজেরিয়া হয়ে মরক্কো থেকে স্পেনে প্রবেশের চেষ্টাও সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা গেছে।
এসব রুটের পাশাপাশি বাংলাদেশি অনিয়মিত অভিবাসীদের কাছে আরেকটি বহুল ব্যবহৃত রুট হল ঢাকা থেকে বিমানযোগে ইরান, তারপর দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে ইরান সীমান্ত থেকে তুরস্ক এবং সেখান থেকে গ্রিস যাওয়া।
ঠিক এই পথ ধরে ইউরোপে আসার লক্ষ্যে ২০১৯ সালের এপ্রিলে তেহরানের উদ্দেশ্যে বিমানযোগে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জের বাসিন্দা রাকিব। বর্তমানে তিনি আছেন গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে একটি অভিবাসন সংস্থা পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে। তিনি ঢাকা থেকে গ্রিস পর্যন্ত দীর্ঘ সাত মাসের যাত্রা নিয়ে কথা বলেছেন।
প্রশ্ন: আপনি কখন ইউরোপের উদ্দেশ্য বাংলাদেশত্যাগ করেন? আপনি কি একা ভ্রমণ করছিলেন?
রাকিব: আমি ২০১৯ সালের এপ্রিলে ঢাকা থেকে ইরানের রাজধানী তেহরানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। মাঝখানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ শহরে একদিন যাত্রাবিরতি করি। ঢাকা থেকে ইরান পৌঁছে দিতে দালালের সাথে আমি ছয় লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। ঢাকা থেকে ইরান পর্যন্ত একই দালালের আওতায় আমি একাই ছিলাম। অবশ্য ইরান থেকে তুরস্ক সীমান্তে গিয়ে অন্য বাংলাদেশি, আফগান ও পাকিস্তানিদের দেখা পেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: আপনি কি বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে আসতে সবগুলো রুটের জন্য একজন দালালের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন? তাদেরকে অর্থ কিভাবে পরিশোধ করতেন?
রাকিব: ইউরোপে পৌঁছাতে আমি একজন মাত্র দালালের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম না।
প্রতিবার একটি নির্দিষ্ট দেশ পর্যন্ত আসতে একজনের সাথে চুক্তি হত। তবে তারা সবাই একে অপরের পরিচিত এবং একজনের সাথে কাজ শেষ হলে অন্যজন পরবর্তী ব্যক্তির সাথে যোগযোগ করিয়ে দিত। যেমন ঢাকা থেকে আরব আমিরাত হয়ে ইরান আসতে আমার সাথে ছয় লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল। এরপর ইরান থেকে তুরস্ক ঢুকতে দেড় লাখ টাকা দিতে হয়েছিল।
সর্বশেষ তুরস্ক থেকে গ্রিসে ঢুকতে দুই হাজার ইউরো বা দুই লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। প্রতিবারই সফলভাবে একটি দেশে পৌঁছাতে পারলে বাংলাদেশে থাকা দালালদের প্রতিনিধির কাছে আমার পরিবারকে টাকা পরিশোধ করতে হতো। দালালরা যাত্রা পথে বা অভিবাসন রুটে কোনো প্রকার টাকার লেনদেন করতে চান না। কারণ সীমান্ত পুলিশসহ বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হলে এসব টাকা আর পাওয়া যাবে না। এছাড়া অভিবাসীরা নগদ অর্থ সাথে রাখতে নিরাপদ মনে করে না। কারণ অভিবাসন রুটে তুষারপাত, বৃষ্টি এবং পানিতে সাঁতার কেটে পার হতে হবে এমন অনেক অঞ্চল থাকে।
প্রশ্ন: ইরান পর্যন্ত তো বিমানেই গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর তুরস্কে কিভাবে গেলেন? ইরান তুরস্ক সীমান্ততো অত্যন্ত দুর্গম ও বিপজ্জনক বলে পরিচিত৷
রাকিব: আপনি ঠিকই বলেছেন, এই পথটিতে টানা হাঁটা লাগে। যেখানে ভয় আর বিপদ ঘিরে ধরে। তেহরান থেকে দালালের গাড়িতে করে ইরান সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। সেখানে গিয়ে দেখি আরও ৩ জন বাংলাদেশি, ৭ জন আফগান, ৪ পাকিস্তানিসহ মোট ১৪ অভিবাসী অপেক্ষা করছে।
কিন্তু সীমান্ত পাড়ি দেয়া এত সোজা না। সেখানে মুহূর্তের মধ্যেই পাল্টে যায় পরিবেশ। আমরা রুট ঠিক না থাকায় মানে দালালরা নিরাপদ মনে না করায় প্রায় ১৮ দিন সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করেছিলাম। অবশেষে টানা ৩ দিন তুষারের মধ্যে হেঁটে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তুরস্কে পৌঁছেছিলাম। তুরস্কের পুলিশ আমাদেরকে সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ পথ থেকে উদ্ধার করে পরে ছেড়ে দিয়েছিল।
প্রশ্ন: তুরস্কে প্রবেশ করে কোথায় গেলেন?
রাকিব: তুরস্কে প্রবেশের আগে দালাল বলে দিয়েছিল আমাদের সীমান্তবর্তী শহরের যেখানে বাস ছাড়বে সেখানে তাদের প্রতিনিধি আমাদের সবাইকে ইস্তাম্বুলগামী বাসের টিকেট দেবে। সেই মোতাবেক আমাদের টিকেট দেয়া হলে আমি ইস্তাম্বুল বাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকা কোচিক বাজার নামক এলাকায় দালালের বাসায় উঠি। সে সময় আমার যতদূর মন পড়ে মে মাস ছিল। পরবর্তীতে চার থেকে পাঁচ মাস আমি সেখানে অবস্থান করি৷
তুরস্কে অবস্থানকালে আমি বিভিন্ন বাংলাদেশি লোকের সহায়তায় কিছুদিন খন্ডকালীন কাজ করেছিলাম। তবে অনিয়মিত অভিবাসী হওয়ায় দিনের বেলা এবং সার্বক্ষনিক কাজ করা বেশ কষ্টকর।
তুরস্ক থেকে গ্রিসে পৌঁছানোর অনেকগুলো রুট আছে। আমি অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ রুটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এজিয়ান সাগর দিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেটি দিয়ে না যেতে আমাকে সবাই বারণ করেছিল। সে কারণে দালালের সাথে দুই হাজার ইউরোর চুক্তিতে সড়ক পথে এবং ছোট খাল পেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: গ্রিসে প্রবেশের প্রস্তুতি কীভাবে নিলেন? ঠিক কোন সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছিলেন গ্রিসে? এ পথ কি নিরাপদ?
রাকিব: আসলে অনিয়মিত অভিবাসনের কোন রুটই নিরাপদ নয়। এখানে সবসময় গ্রেপ্তার ও জীবন হারানোর ভয় কাজ করে। কিন্তু একবার এই রুটে রওনা দিলে পেছনে ফেরার সুযোগ থাকে না। আমরা একটি মালগাড়িতে করে ইস্তাম্বুল থেকে যাত্রা করেছিলাম।
প্রায় পাঁচঘন্টা গাড়িতে চড়ে আমরা গ্রিসের আলেকজান্দ্রোপলিস শহরের পাশে থাকা একটি সীমান্ত খালের নিকটে এসে পৌঁছাই। সেখানে প্লাস্টিকের নৌকায় আমরা একটি জলাশয় (বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাছে সাদা খাল নামে পরিচিত) পাড়ি দিয়ে গ্রিসে পৌঁছালে বেশ কিছু পথ হাঁটার পর দালালদের একটি বড় ট্রাক দেখতে পাই যেটি আমাদের অপেক্ষায় ছিল।
আমরা সেখানে বিভিন্ন দেশের প্রায় ১২০ জন অভিবাসী ছিলাম। যাদের মধ্যে আমরা ৫০ জন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলাম। ট্রাক আমাদের সবাইকে গ্রিসের সালোনিকি শহরে নামিয়ে দেয়। আমি গ্রিসে থাকা আমার পূর্ব পরিচিত ব্যক্তিদের পরামর্শে এথেন্স চলে আসি। মূলত ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর আমি গ্রিসে এসে পৌঁছেছিলাম।
প্রশ্ন: একজন অনিয়মিত অভিবাসী হিসেবে গ্রিসে থাকার অভিজ্ঞতা কেমন? জীবনযাত্রা ব্যয় কীভাবে মেটাতেন? রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন কি করেছিলেন?
রাকিব: আমি গ্রিসে আসার পর এথেন্সে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত অবস্থান করি। সে সময় প্রচুর ধরপাকড় চলায় আমি তখন রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন জমা দেয়া থেকে বিরত থাকি।
জানুয়ারির পর থেকে গ্রিসের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিক্ষেতে সিজনাল কাজ পাওয়া যায়। বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে টমেটো, পেঁয়াজ, স্ট্রবেরি ও কমলা তোলার কাজ পাওয়া যায়। আমি সিজনাল এসব কাজ চালিয়ে যেতে থাকি। এসব কৃষিক্ষেতে দৈনিক সাতঘন্টা কাজের বিপরীতে ২৪ ইউরো বা আড়াই হাজার টাকা মজুরি দেয়া হয়। তবে শীতকালে তিন থেকে চার মাস কোনো কাজ থাকে না।
অনেক কষ্ট হলেও এভাবেই দিন চলছিল। পরে করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন আমি কাজ পাই নাই।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আবারও কাজ শুরু করি। বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে স্ট্রবেরি, কমলা ও পেঁয়াজ তোলার কাজ শেষ করে ৬ মে এথেন্সে ফিরে আসি। এথেন্সের বাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকায় এক বাসায় ছিলাম। ১৫ মে বাসা থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে দেখি অনিয়মিত অভিবাসীদের ধরতে পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। আমার কাছে কোন বৈধ কাগজ না থাকায় তারা আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
প্রশ্ন: পুলিশ গ্রেপ্তারের পর কোথায় নিয়ে যায়? বাংলাদেশে ডিপোর্ট হওয়ার ঝুঁকি ছিল?
রাকিব: গ্রেপ্তারের পর আমাকে গ্রিসের মেনিদি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ক্যাম্পে গিয়ে শুনি ১৬ জন বাংলাদেশিকে ডিপোর্টের জন্য করোনা পিসিআর টেস্ট করতে নেয়া হয়েছে। আমিতো এটা শুনেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অবশ্য পরবর্তীতে তাদের ডিপোর্ট স্থগিত হয় বলে জানতে পারি। আমি প্রশাসনের কাছে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে সুরক্ষা আবেদন করলে আমার আবেদন নথিভুক্ত করে অন্য একটি সংস্থার আওতায় আমাকে আলাদা একটি ক্যাম্পে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।
আশ্রয় আবেদন জমা নেয়ার পর আমাকে ২৭ জুন মেনিদি ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। এখন আমি নতুন শিবিরে আছি। আগামী মাসে আমার সুরক্ষা আবেদনের উপর সাক্ষাৎকার হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রশ্ন: এই যে দীর্ঘ পথে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে এলেন। রুটে কি দালালদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন?
রাকিব: মানবপাচার চক্রে জড়িত সব দালালই অত্যন্ত অমানবিক। নির্দিষ্ট কাজ শেষ হওয়ার পর তাদের দেয়া তারিখ ও টাকার পরিমাণে একটু এদিক ওদিক হলেই নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। আমাকে অন্যান্য অভিবাসীরা এসব কথা বারবার বলে দিয়েছিল। সেই হিসেবে আমার পরিবার তাদেরকে সঠিক সময়ে অর্থ পরিশোধ করায় আমার উপর বড় কোনো নির্যাতন হয়নি। তবে যাত্রা পথে তারা অত্যন্ত অপমানজনক ব্যবহার করে থাকে।
(সাক্ষাৎকার প্রদানকারীর অনুরোধে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। )
শেয়ার করুন