সিলেট বিআরটিএ অফিস। এখানে টাকা ও দালাল ছাড়া কেউ কাজ করতে গেলে তিনি শেষে পথ খুঁজে পাবেন না বলে জানান ভুক্তভোগীরা। প্রতি পদে ভোগান্তির শিকার হয়ে শেষে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে কাউকে কাজ বুঝিয়ে দিবেন। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য লার্নার ফরম নেয়া থেকে শুরু করে জমা দেয়া, পরীক্ষা, ফিল্ড টেস্ট, বায়োমেট্রিক ছাপ, নবায়ন; এছাড়া, গাড়ির ফিটনেস, রোড পরামিটসহ সব কাজে দালালের মাধ্যমে না গেলে শেষে বোকামির দন্ড দিতে হয়। তারপরও স্বাভাবিক নিয়মে একজনের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে যেখানে সাড়ে ৩মাস লাগার কথা, সেখানে প্রায় এক বছর সময় লেগে যায়। তার উপর পেশাদার লাইসেন্স করতে যেখানে ২ হাজার ও অপেশাদার এর জন্য ৩ হাজার টাকা ফি নির্ধারিত, সেখানে ৭ হাজার টাকার নিচে কোন লাইসেন্স করা যায় না। আবার কোন কিছু না পারলেও ১৬ হাজার টাকায় মিলে যায় লাইসেন্স। লাইসেন্স পেতে ভোগান্তি, দীর্ঘসূত্রিতা ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে অনেকেই লাইসেন্স নিতে আগ্রহী হন না বলে জানান তারা। তবে আঙ্গুলের ছাপ দেয়ার জন্য যেখানে একসময় দীর্ঘ লাইন থাকতো, বর্তমানে সেই লাইন খুব বড় দেখা যায় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে প্রথমে লার্নার হতে হয়। ৩ মাসের জন্য লার্নার হিসেবে গাড়ি চালানোর অনুমোদন দেয়া হয়। দুই মাস পরে পরীক্ষা নেয়া হয়(লিখিত-১০, ভাইভা-২০, ফিল্ড টেস্ট-৭০)। পরীক্ষায় পাশ করলে পুলিশ ভেরিফিকেশন, বায়োমেট্রিক ছাপসহ আনুসাঙ্গিক কাজে মোট সাড়ে ৩ মাসে লাইসেন্স পাওয়া যায়। পেশাদার লাইসেন্স পেতে প্রায় ২ হাজার এবং অপেশাদার লাইসেন্স পেতে প্রায় ৩ হাজার টাকা লাগে। কিন্তু বাস্তবে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৭ হাজার টাকার নিচে কোন লাইসেন্স করা যায় না এবং ৮মাস থেকে বছরের আগে সেই লাইসেন্স পাওয়া যায় না।
ভুক্তভোগীরা জানান, ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গেলে প্রথমেই লার্নার হতে হয়। সেই লার্নার ফরম সংগ্রহ থেকেই শুরু হয় ভোগান্তি। লার্নার ফরম অফিস থেকে দেয়ার কথা থাকলেও সব সময় পাওয়া যায় না। বলা হয় নিচে থেকে নিয়ে আসতে। আবার সেই ফরম পূরণ করে জমা দিতেও লাইনে থাকতে হয়। জমা দেয়ার সময়ও দিতে হয় টাকা। এভাবে ৬শ টাকার লার্নার লাইসেন্স নিতে প্রায় হাজার টাকা ব্যয় হয়ে যায়। একই ভাবে নির্দিষ্ট মাধ্যমে না গেলে ও অতিরিক্ত টাকা ব্যয় না করলে ড্রাইভিং পরীক্ষায় নিকটবর্তী সময়ে বসা যায় না, পরীক্ষা দিলেও ফেল রাখা, পুলিশ ভেরিফিকেশন, বায়োমেট্রিক ছাপ দিতে দীর্ঘ লাইন অর্থাৎ লাইসেন্স প্রাপ্তির সকল ধাপে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। পরে লাইসেন্স পেতে ৪ পৃষ্ঠার একটি ইংরেজি ফরম পূরণ করতে হয়। যা অধিকাংশের জন্যই প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বিকল্প পথে গেলে ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা দিলে শুধু নির্দিষ্ট দিন উপস্থিত হলেই ধারাবাহিকভাবে সব কাজ হয়ে যায়। আবার কোন কিছু না পারলেও ১৬ হাজার টাকা দিলে নির্দিষ্ট দিনে উপস্থিত হলেই পাশ করা যায়।
এদিকে, লার্নার লাইসেন্সের মেয়াদ থাকে ৩মাস কিন্তু সেখানে পরীক্ষার তারিখ দেয়া হয় প্রায় ৬ থেকে ৮ মাস পরে। তারা একজনের আবেদনের কপি দেখিয়ে বলেন, তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করেন গত জুনে। তাকে লার্নার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ৩ মাসের । কিন্তু, তার পরীক্ষার সময় দেয়া হয়েছে আগামী ডিসেম্বরে। ডিসেম্বরে পরীক্ষা হলে এর পর ফি জমা, বায়োমেট্রিক ছাপ, পুলিশ রিপোর্টসহ সকল কাজ শেষ হতে মোট ৮ মাসের উপরে লাগবে। গত মঙ্গলবার আরেক ব্যক্তিকে পাওয়া যায়, যিনি লার্নার পেয়েছেন ২৭ আগস্ট এবং তার মেয়াদ ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু তাকে পরীক্ষার তারিখ দেয়া হয়েছে প্রায় ৮মাস পরে ২০১৯ সালের ২১ মে। গতকাল একই সময় বিআরটিএ অফিসে আসা কয়েক জনের সাথে কথা বললে সকলেই জানায় তারা অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়েছেন। শুধু লাইসেন্সই নয়, গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি বাদে মোটরসাইকেলের জন্য দিতে হয় ৭শ টাকা, কার, মাইক্রোবাস, লেগুনা, হাইয়েস এর জন্য ১ হাজার, বাস ২ হাজার এবং ট্রাকের জন্য দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। একইভাবে রুট পারমিটের জন্যেও প্রত্যেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা দিতে হয়।
দীর্ঘদিন থেকে গাড়ি ব্যবসা ও চালনার সাথে জড়িত মকসুদ আহমদ বলেন, বিআরটিএ ‘ভূতের বাড়ি’। এখানে কেউ নিয়ম মেনে চলতে গেলে তিনি দিশেহারা হয়ে বেরিয়ে আসবেন। ৮মাস পূর্বে, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকার পরও নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে গিয়ে নির্ধারিত প্রায় ৩ হাজার টাকা খরচের স্থানে ঠিকই ৭ হাজার টাকা খরচ এবং ৬ মাস খোয়াতে হয়েছে। নিজের শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় করে সীমাহীন ভোগান্তির জন্য পরে নিজেকেই নিজেকে তিরষ্কার করেছি। তিনি বিআরটিএ কে ভোগান্তি মুক্ত করতে এবং গাড়ির কাগজ ও লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ করতে নীতিনির্ধারকদের সুদৃষ্টি কামনা করেন। এদিকে, সিএনজি চালক রায়হান উদ্দিন জানান, ২০০২ সালে লাইসেন্স করার পর ভোগান্তির চিন্তা করে আর নবায়ন করা হয়নি। কিছুদিন পূর্বে সাড়ে ১০ হাজার টাকায় নতুন লাইসেন্স নিয়েছেন।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মারুফ আহমদ বলেন, অনেকেই আছেন টাকা খরচ ও ভোগান্তির ভয়ে লাইসেন্স করতে যান না। ভোগান্তি ছাড়া নির্ধারিত সময়ে লাইসেন্স করা গেলে সকলে লাইসেন্স করতে উদ্যোগী হতেন।
এব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাই নিসচা এর কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিলেটের উপদেষ্টা মো. জহিরুল ইসলাম মিশু বলেন, বিষয়টি যখন সমানে চলে এসেছে তখন আর অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। নিরাপদ সড়ক এখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সড়ক নিরাপদ করতে হলে চালকদের দুর্ভোগ লাঘব করতে হবে এবং বিআরটিএকে জনবান্ধব-স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।
তিনি বলেন, লাইসেন্স সবাই নিতে আগ্রহী। কিন্তু ভোগান্তির বিষয়টি যখন চিন্তা করে তখন অনেকে পিছু হটেন। বিআরটিএ তে কোন অনিয়ম থাকলে সরকারি সংস্থা র্যাব, দুদক ব্যবস্থা নিতে পারে। একই সাথে বিআরটিএ এর কাঠামোগত সম্প্রসারণে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
শেয়ার করুন