সিলেট সিটি নির্বাচন: ভয় বাড়াচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি

সিলেট

সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনের বাকি আর মাত্র তিন দিন। শেষ সময়ের প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটছে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ভোটের মাঠে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী। তবু আশা ছাড়ছেন না প্রতিদ্বন্দ্বীরা। কাউন্সিলর পদে মিলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস। জয়ের মালা উঠবে কার গলায় তা নিয়ে নানা হিসাব কষছেন ভোটাররা, ঠিক তখনই ভয় বাড়াচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি।

গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের পর পাহাড়ি ঢলে টইটম্বুর সুরমা নদীর প্রবাহ শনিবার (১৭ জুন) কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ বন্যায় আসন্ন ভোটের যাবতীয় আয়োজন ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সিলেটে অন্তত তিন দফা বন্যায় বানভাসি দিন কেটেছে নগরীর বেশিরভাগ মানুষের। এমনকি অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত উপশহরের মানুষও পানিবন্দি হয়ে পড়েন। সুরমা তীরবর্তী এলাকার বস্তিবাসীর দুর্ভোগের সীমা ছিল না। এসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন বিপুলসংখ্যক মানুষ। এমন ১৯০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সিটি নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র করা হয়েছে। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতি খারাপ হলে ফের এসব প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবেন নগরের বাসিন্দারা। সেই প্রেক্ষাপটে এসব প্রতিষ্ঠান ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে কি না- তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে নির্বাচন নিয়েই উদ্বেগে পড়েছেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা।

গেল বছরের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। সেই বিপর্যয়ের ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি অনেকে। ওই বন্যায় নগরীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দিনের পর দিন পানিবন্দি হয়ে মানবেতর দিনযাপনে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সেই পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে বন্যা ঠেকাতে গত এক বছরে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত বৃহস্পতিবার সকালে টানা বর্ষণের পর নগরীর বড় একটি অংশ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে আবার। গত শুক্রবারও নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তা ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি অনেকের বাসাবাড়ি ও দোকানপাটেও ময়লা পানি ঢুকেছে। নগরীর বর্ধিত এলাকার নিম্নাঞ্চলেও পানি বাড়ছে।

এদিকে টানা বৃষ্টিপাতে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের দৈনন্দিন প্রচারেও ব্যাঘাত ঘটছে।

শনিবার (১৭ জুন) দুপুর সাড়ে ১২টায় নগরীর বাবনা পয়েন্ট থেকে লাউয়াই পর্যন্ত জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুলের গণসংযোগ করার কথা ছিল। বৃষ্টির জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত দুপুর সোয়া ২টার দিকে গণসংযোগ শুরু করেন।

একইভাবে দুপুর ১২টায় নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। বৃষ্টির জন্য তাকেও নির্ধারিত সময়ে ৪০ মিনিট পর ইশতেহার ঘোষণা করতে হয়।

নগরীর ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী কামরুল হোসেন বলেন, বৃষ্টির জন্য প্রচারে বিঘ্ন হচ্ছে। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগও রয়েছে।

গতবার বন্যার পর নগরীকে রক্ষায় সুরমা নদী খননের পাশাপাশি শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণের প্রসঙ্গ আলোচনা উঠে আসে। শত শত কোটি টাকা খরচের পরও নগরীর জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ নিরসন না হওয়ায় সমালোচিত হন বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সেই সময় মেয়র সুরমা নদীর নাব্যতা সংকটকে দায়ী করেছিলেন। তবে দুদিন আগে সুরমার পানি বিপৎসীমার নিচে থাকলেও জলমগ্ন হয় নগরী। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচিত হলে জলাবদ্ধতা নিরসনকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন নৌকার মেয়রপ্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। বৃষ্টির জন্য নির্ধারিত সময়ের পর ঘোষিত ইশতেহারে এই সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন তিনি।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সিলেটে ১১৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। শনিবার (১৭ জুন) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সিলেটে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পাহাড়ি ঢল নামার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে সকালে সিলেটের প্রায় সবকটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমায় পৌঁছেছে। বিকালে সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, সুরমা নদী কানাইঘাট পয়েন্টে দশমিক ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভায় সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান জানান, সিলেটে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। আগামী ১৫ দিন এ বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম নানা প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

নগরীর ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার নির্বাচনী এলাকা মোহাম্মদপুরের অনেক রাস্তায় পানি উঠেছে। নিম্নাঞ্চলের কিছু বাড়িঘর প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় সৈয়দ জাহান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটকেন্দ্র করা হয়েছে। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ওই বিদ্যালয়ে পানি জমেছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে পানি আরও বাড়বে। পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক।

নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মঈন উদ্দিন বলেন, যেভাবে প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এমন হলে নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে। সাধারণ মানুষ তথা ভোটারের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সুষ্ঠু ভোটের জন্য সবকিছু বিবেচনায় নিতে হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে সিলেটে বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে জেলা প্রশাসন সম্ভাব্য বন্যা মোকাবিলায় সভা করে প্রস্তুতির কথা বলেছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে না।

জানতে চাইলে সিলেট সিটি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সল কাদের জানান, সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা।

প্রসঙ্গত, আগামী ২১ জুন ইভিএমে সিলেট সিটিতে অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *