সিলেট-৬: তৃণমূল বিএনপির শমসেরকে জেতাতে মাঠে আওয়ামী লীগ

সিলেট

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে সিলেট-৬ আসনের প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের গৃহদাহ ততই বাড়ছে। প্রকাশ্যে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় স্ব স্ব প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী জনসভায় যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে এমন বিষোদগার করায় উত্তেজনা ক্রমশ সহিংসতায় রূপ নিতে পারে- এমন মন্তব্য করছেন সাধারণ ভোটাররা।

এদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ এবারও নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে থাকলেও তাকে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও কানাডা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরোয়ার হোসেন (ঈগল)। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে দুই প্রার্থীর অনুসারীরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় ভোটের মাঠ গরম করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেইসঙ্গে দুই প্রার্থীর নেতাকর্মীরা প্রচারে নেমে একে অন্যের সম্পর্কে বিষোদগার করছেন, এমন অভিযোগ সাধারণ ভোটারদের। যে কারণে এই নির্বাচনী এলাকায় দুই প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট-৬ আসনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ মূলত তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দলের প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ (নৌকা) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেনের (ঈগল) পক্ষে দুটি পক্ষ সরব। আরেকটি পক্ষ প্রকাশ্যে সরব না থাকলেও ভেতরে-ভেতরে শমসেরের পক্ষে সক্রিয়। এর মধ্যে নৌকার মনোনয়নে গোলাপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া মঞ্জুর শাফি চৌধুরী ওরফে এলিমও আছেন।

এরই মধ্যে সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরীর পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচারণায় নেমেছে আওয়ামী লীগের বড় একটি গ্রুপ। এ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী থাকলেও একটি অংশ শমসেরের প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধিও কাজ করছেন শমসেরের পক্ষে।

গতকাল গোলাপগঞ্জ উপজেলার একাধিক স্থানে শমসের মুবিন চৌধুরীর গণসংযোগের সময়ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে দেখা গেছে। তার পথসভায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক এক নেতা বক্তব্যও দেন। ওই নেতা শমসেরকে সোনালী আঁশ প্রতীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করার আহ্বানও জানান।

এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম নাহিদ। আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনি ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর টানা দুই দফা শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

অন্যদিকে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা শমসের মুবিন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর বিকল্পধারা বাংলাদেশে যোগ দিয়ে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হন। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিকল্পধারার মনোনয়নে সিলেট-৬ আসনে প্রার্থী হন। তবে নুরুল ইসলাম নাহিদকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।

জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মঞ্জুর শাফি চৌধুরী কাছে দাবি করেন, তিনি তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যানের পক্ষে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে কোনো অবস্থান নেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপ আছে শমসেরের পক্ষে মাঠে নামার জন্য। তাই দলের প্রভাবশালী কিছু নেতা আড়ালে শমসেরের পক্ষে কাজ করছেন। এ ছাড়া প্রকাশ্যেও দলটির কয়েকজন কর্মী শমসেরের পক্ষে গণসংযোগের পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ ও পথসভা করছেন। একই সঙ্গে সরওয়ারের পক্ষেও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ রয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রকাশ্যে শমসেরের পক্ষে কাজ করছেন গোলাপগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সহদপ্তর সম্পাদক মিনহাজ উদ্দিন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ও পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আশিকুর রহমান। তারা জানান, বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে দলের কর্মী-সমর্থকদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই তাদের মতো আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী শমসেরের পক্ষে আছেন।

উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দাবি করা শফিকুর রহমান বলেন, ‘শমসের মুবিনের বাড়ি গোলাপগঞ্জ। অন্যদের বাড়ি বিয়ানীবাজারে। তাই উপজেলার বাসিন্দা হিসেবে আমি শমসের মুবিনের পক্ষে। পাঁচ বছর আগে বর্তমান সংসদ সদস্যের পক্ষে আমি সরব ছিলাম। নির্বাচন শেষে তিনি আর কর্মীদের খবর নেননি। এ ক্ষোভেও আমি এবার ভালো মানুষের পক্ষে আছি।’

আলাপকালে শমসের মুবিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার পথসভা ও গণসংযোগে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যোগ দিয়েছেন মূলত আমি গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা বলে। দলমত-নির্বিশেষে এ আসনের ভোটাররা আমার জয় দেখতে চান।’

তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যানের গণসংযোগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের থাকার বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন খান বলেন, হয়তো কয়েকজন নেতা-কর্মী শমসের মুবিন চৌধুরীর পক্ষে আছেন। তবে এখানে নৌকাই জিতবে।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দু-চারজন হয়তো একটু এদিক-সেদিক আছেন। তবে পুরো আওয়ামী লীগ পরিবারই আমার সঙ্গে আছে। সংসদ সদস্য থাকাকালে এখানে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষজন আবার আমাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে।’

এদিকে স্ব স্ব প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী জনসভায় যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে এমন বিষোদগার করায় উত্তেজনাও বাড়ছে এ আসনে।

উপজেলার ঢাকাদক্ষিণের ঈগল প্রতীকের প্রার্থী সরোয়ার হোসেনের পক্ষে নির্বাচনী বক্তব্যে বিয়ানীবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব (নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে উদ্দেশ্য করে) বলেন, ‘অজু ছাড়া যে নামাজে বা জানাযায় যায়, তাকে ভোট দেওয়া ঠিক নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের নাহিদ ভাই এমন কাজ করেন, আমি এর স্বাক্ষী। এইবার আমরা এমন একজনকে সংসদে পাঠাব, যাকে পেতে হলে কোনো খলিফা ধরা লাগবে না।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এম এ ওয়াদুদ এমরুল বলেন, নির্বাচনে গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও কয়েক ভাগে বিভক্ত। যারা প্রকাশ্যে নুরুল ইসলাম নাহিদের পক্ষে আছে, তারাও ভেতরে ভেতরে সরোয়ার হোসেনের সঙ্গে প্রকাশ্যে যোগাযোগ রাখছে। সুষ্ঠু ভোট হলে সরোয়ার হোসেনই জয়ী হবেন। অপরদিকে নুরুল ইসলাম নাহিদের সমর্থকরাও বলছেন, বর্তমান এমপি বিজয়ী হবেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আকবর আলী ফখর বলেন, দলের তৃণমূলের কর্মীরাই নাহিদ ভাইয়ের শক্তি, না হলে বারবার তিনি (নাহিদ) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেতেন না। তার সময়ে গোলাপগঞ্জ বিয়ানীবাজারে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসাসহ সব ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হয়েছে, বিগত দিনে এমন উন্নয়ন কেউ করেনি। বর্তমান সরকারের সব ধরণের উন্নয়নের ছোঁয়া তার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে লেগেছে। কিছু কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে। আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের মাধ্যমে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করে ভোটাররা এর দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেবে।

উপজেলার স্থানীয় ঢাকাদক্ষিণ বাজারে শুক্রবার এক নির্বাচনী জনসভায় সরোয়ার হোসেন বলেন, আমি বিগত ১৫ বছর ধরে কানাডার বিলাস জীবন পরিত্যাগ করে এই দুই উপজেলার মানুষের সেবা করে যাচ্ছি। জনগণও আমাকে এমপি হতে উৎসাহিত করে চলেছে। তাছাড়া নেত্রীর নির্দেশেই আমি ভোটে এসেছি। প্রশাসনও এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ আছে। এভাবে থাকলে, জয় আমারই হবে। তৃণমূলের কর্মীরা ৭ জানুয়ারি ভোটের মাধ্যমে এর জবাব দেবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *