দুর্নীতি যেন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে বার বার সামনে আসছে সিসিকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কনজারভেন্সি শাখার প্রধান হানিফুর রহমানের নাম।এমনকি তার মাধ্যমে নিয়োগ করা সুবিধাভোগী কর্মচারীও এখন বাড়ি-গাড়ির মালিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী কার্যালয়ের (পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার) সামনে থেকে গায়েব হয়েছিল তিনটি গাড়ি। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ওই বছরের ২৪ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (নং-১৯৪৯) করেছিলেন সিসিকের পরিবহন শাখার উপ-সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) জাবেরুল ইসলাম।
সাধারণ ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়, ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় রাখা তিনটি গাড়ির (সিলেট ব- ৬১৪৮, সিলেট ব-৫৪১০ ও সিলেট ঘ-০২ ০০৪৮) হদিস যথাস্থানে মিলছিল না। অস্থায়ী কার্যালয় থেকে গায়েব হওয়া তিনটি গাড়ির মধ্যে একটি ট্রাকও ছিল। পরে জিডি মামলায় রূপান্তরিত হয়।
একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় থাকা গাড়িগুলো গায়েব হওয়া নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। ওই সময় ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন সিসিকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমান।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হানিফ আসামি থাকলেও নগর ভবনের ইন্টারনাল (অভ্যন্তরীণ) তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সিসিকের সাবেক সচিব (বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) বদরুল হক। এই কারণে তদন্ত কমিটি গাড়ি গায়েবের মামলাটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়।
হানিফুর রহমান স্বীকার করেছেন ওই ঘটনায় তিনি আসামি ছিলেন।তবে অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটিতে ছিলেন না। তবে বদরুল হক ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন, এ তথ্য তিনি নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে জানতে বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বদরুল হককে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ঘটনার পাঁচ বছর পর বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। কনজারভেন্সি শাখার কর্মীদের কাছ থেকে ওই তিন গাড়ি চুরির ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিসিকের কনজারভেন্সি শাখার একাধিক কর্মী জানান, চোরাই গাড়িগুলো সিলেট থেকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল যায়। কিন্তু সিসিক থেকে দেখানো হয় নষ্ট গাড়িগুলোর যন্ত্রাংশ পারাইরচক ডাম্পিং ইয়ার্ডে পাওয়া যায়।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার পর যখন মামলার তদন্ত চলছিল, তখন নগরের দক্ষিণ সুরমা গোটাটিকর এলাকার একটি গাড়ির গ্যারেজ থেকে ভাঙা গাড়ির ডালা, দরজাসহ কিছু যন্ত্রাংশ কিনে রাস্তা সংলগ্ন একটি বিদ্যুতের খুঁটির পাশে রাখা হয়। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে তারই নির্দেশে কনজারভেন্সি শাখার এক চালককে দিয়ে রাতের আঁধারে সিসিকের ট্রাকযোগে ভাঙা মালামালগুলো পারাইরচক ডাম্পিংয়ে ফেলে রাখা হয়, যাতে তদন্তে গিয়ে পুলিশ দেখতে পায় গাড়িটির ভাঙা যন্ত্রাংশ সেখানে রয়েছে। পুলিশও তদন্তে এমনটি পায়। সে সময়ে এ নিয়ে নগর ভবনে নানা গুঞ্জন চললেও কেউই এ নিয়ে মুখ খোলেননি।
সূত্রে জানায়, সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী কার্যালয় থেকে গাড়ি তিনটি গায়েব করার নেপথ্যে ছিলেন করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমান।ঘটনার রাতে অস্থায়ী কার্যালয়ের সামনে তার উপস্থিতির কথাও নিশ্চিত করেন তারই অধীনস্থ এক কর্মচারী। আর দায় এড়াতে রহস্যজনক কারণে নিখোঁজের কথা উল্লেখ করে সাধারণ ডায়েরি করানো হয়। অথচ সে সময় অভিযোগ ওঠে, হানিফুর রহমান এই গাড়িগুলো টেন্ডার ছাড়াই লোকচক্ষুর আড়ালে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
পরে ওই ঘটনা উপস্থাপন করে সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেছিলেন, গাড়িগুলো চুরি হয়নি। এগুলো নষ্ট হওয়ায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সিসিকের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমান বলেন, ওই সময় গাড়ি চুরির মামলায় আমিও আসামি ছিলাম। তবে মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে। পাঁচ বছর আগের ঘটনা এখন কিছুই বলতে পারব না।গাড়ির যন্ত্রাংশ কিনে নিয়ে ডাম্পিং ইয়ার্ডে ফেলার ঘটনাটি সত্য নয় বলে দাবি করেন তিনি।
শেয়ার করুন