সুনামগঞ্জে অবৈধ সুদ ব্যবসা

সুনামগঞ্জ

সম্প্রতি ‘তাহিরপুরে সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় যুবকের করুণ মৃত্যু’ শীর্ষক একটি মর্মান্তিক সংবাদ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় নিজের ফেইসবুক আইডিতে স্ট্যাটাস অর্থাৎ ঘোষণা দিয়ে এক যুবক আত্মহত্যা করেছেন। মৃত যুবকের নাম ফয়সাল আহমদ সৌরভ (২৭)। তিনি উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়নের পাতারি গ্রামের বাসিন্দা। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানা যায়, ফয়সাল বাদাঘাট ইউনিয়নের জনৈক ব্যক্তির নিকট থেকে সুদে এক লাখ টাকা ঋণ নেন। সেই টাকার বিপরীতে তিনি ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু তা সত্বেও সেই সুদের বেড়াজাল থেকে তিনি বের হতে পারেননি। সফিক ৩ লাখ টাকা সুদ নেয়ার পর আরো ৩ লাখ টাকার জন্য চাপ দেন। সেই চাপ সইতে না পেরে ফয়সাল আহমদ সৌরভ আত্মহত্যা করেন। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মর্মান্তিক এ ঘটনা।

উল্লেখ্য, গ্রামগঞ্জে চড়া সুদের ব্যবসা করে মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে একশ্রেণীর কারবারি। অথচ তাদের সুদ ব্যবসার জন্য নিবন্ধন বা অনুমতি নেই। সমবায় সমিতির নামে, কেউবা ব্যক্তিগতভাবে চড়া সুদে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এতে ঋণগগ্রস্ত মানুষ পথে বসছেন। নিঃস্ব হচ্ছেন। লক্ষণীয় যে, দেশের অনিবন্ধিত ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও সমবায় সমিতি বন্ধে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। একই সঙ্গে অননুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডের বিষয়ে তদন্ত করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠনে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছিলেন আদালত। তদন্তকালে কোন অননুমোদিত বা লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেলে তাৎক্ষনিক সেগুলো বন্ধ করে আইনগত ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয় এই আদেশে। এছাড়া চড়া সুদে ঋণদানকারী স্থানীয় মহাজনদের তালিকা দিতে মাইক্রোক্রেডিট রেগগুলেটরী অথরিটিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। তবে সুদ ব্যবসা বন্ধে এমন নির্দেশনা সত্বেও দেদারসে চলছে সুদখোরদের রমরমা বাণিজ্য। একই সাথে বেড়েছে তাদের দৌরাত্ম্য। এ অবস্থায় শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত অবৈধ সুদের ব্যবসার সাথে জড়িতদের তালিকা তৈরী করে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি, এমনটি জানা গেছে।

জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলায় অবৈধ সুদের ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে কয়েক হাজার মহাজন। কেউ নামে, কেউ বেনামে সংগঠন সমিতি বা ব্যক্তি পর্যায়ে সুদে টাকা লেনদেনের ব্যবসা করে থাকেন। ক্ষুদ্র মাঝারিসহ বৃহজৎ আকারে এই ব্যবসা পরিচালিত হয়ে থাকে। দিন সপ্তাহ, মাস কিংবা বার্ষিক হারে সুদ গ্রহণ করেন দাদন ব্যবসায়ীরা। অয়নেকেই প্রমান হিসেবে ঋণগ্রহণকারী ব্যক্তির নিকট থেকে জমির দলিল, চেকের পাতা, মূল্যবান জিনিসপত্র অথবা বন্ডসই আদায় করে থাকেন। যা এক সময়ে সুদ আদায়ে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সুদে টাকা গ্রহণ করে চড়া সুদ পরিশোধ না করতে পেরে চক্রবৃদ্ধি সুদে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। এভাবে এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলা শহরসহ উপজেলা পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী ও লোকজন সুদের ব্যবসার খপ্পরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

আরও জানা গেছে, সুনামগঞ্জ পৌর শহরে রয়েছে সুদ ব্যবসার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সমিতি বা ব্যক্তি বিশেষের নামে এবং প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় সুদের ব্যবসা কগরে শক্তিশালী সিন্ডিকেটটি হাতিয়ে নিচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসা বাড়ি। সুদী মহাজনের খপ্পরে পরে ইতোমধ্যে শহরের অনেক গার্মেন্টস ব্যবসায়ীসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা এই সুদের ব্যবসার মাধ্যমে রাতারাতি শূন্য থেকে অট্টালিকার মালিক বনেছেন। হয়েছেন অঢেল অর্থ ও সম্পদের মালিক।

লক্ষণীয় যে, সিলেট বিভাগের অন্যান্য জেলার তুলনায় সুনামগঞ্জে বিশেষভাবে এর হাওরাঞ্চলে বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাস। এদের অনেকেই বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। ফলে কোন বছর ফসল ঠিকমতো তুলতে না পারলে তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে চড়া সুদে অর্থ ধার করে। তাই হাওরাঞ্চলের বোরো নির্ভর এসব মানুষের একটি বড় অংশ দাদন ব্যবসায়ীদের মক্কেল। এছাড়া এই জেলায় শিল্প কারখানা বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মসংস্থানেরও বিশাল ঘাটতি বিদ্যমান। এটা সুদখোর মহাজনদের নিকট থেকে অর্থ ধারের অন্যতম কারণ।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রবাসী অধ্যুষিত না হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ রেমিট্যান্সও আসে কম। ফলে লোকজনের মাঝে নগদ অর্থের অভাব প্রকট থাকে সারা বছর। এসব অবস্থা বিবেচনা করে সুনামগঞ্জ জেলায় কর্মসংস্থাদের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি, শিল্প কারখানা স্থাপন এবং বিদেশে জনশক্তি রফতানীর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন, যাতে এ অঞ্চলের লোকজনকে নগদ অর্থের জন্য অর্থ পিশাচ সুদখোর মহাজনদের দ্বারস্থ হতে না হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকেরও মনোযোগ দেয়া দরকার। এর পাশাপাশি কঠোর হস্তে দমন করতে হবে অসাধু সুদখোর সিন্ডিকেটের অবৈধ কর্মকান্ড। বন্ধ করতে হবে অবৈধ সুদ ব্যবসা। আমরা এই অভিশপ্ত সুদ ব্যবসা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *