দিরাই ও শাল্লা নিয়ে সুনামগঞ্জ-২ আসন। এই দুই উপজেলা জেলার ভাটি এলাকা হিসেবে পরিচিত। এই ভাটিতে এবার ভোট দুই কারণে বেশি আলোচিত। একটি হলো, দীর্ঘদিন পর এবার ‘সেন’ পরিবার থেকে নৌকা ছুটে গেছে। অন্য কারণ, নৌকা এবার যাঁর ঘাটে ভিড়েছে, তিনি আওয়ামী পরিবারেরই লোক। তবে এই পরিচয় ছাপিয়ে মানুষের মুখে ফিরছে তিনি ‘আইজিপির ভাই’।
এই আসনে এবার নৌকা প্রতীক পেয়েছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মাহমুদ। তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের ছোট ভাই। নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তা (কাঁচি)। তিনি আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এই দুই প্রার্থীর বাইরে আরেকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সচিব মিজানুর রহমান (ঈগল)।
ভোটের মাঠে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মাহমুদ ও জয়া সেনগুপ্তা সভা-সমাবেশে একে অপরের প্রতি বিরূপ কোনো মন্তব্য না করলেও তাঁদের পক্ষে থাকা দলীয় নেতা-কর্মীরা কথা ও বক্তৃতায় একে অপরকে মাঝেমধ্যে আক্রমণ করছেন। তবে দুই প্রার্থীই তাঁদের সতর্ক করে দিচ্ছেন।
জয়া সেনগুপ্তা ও তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা মনে করছেন, ‘আইজিপির ভাই’ পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে ভোটে সুবিধা নিতে পারেন নৌকার প্রার্থী। আবার নৌকার সমর্থকেরা মনে করেন, একই পরিচয় সামনে এনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বাড়তি চাপে রাখার কৌশল আছে জয়া সেনগুপ্তার সমর্থকদের। দিরাই-শাল্লায় গত বুধবার দিনভর ঘুরে প্রার্থী, দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই আভাস পাওয়া গেছে।
জয়া সেনগুপ্তা বুধবার দুপুরে তাঁর দিরাই শহরের বাড়িতে বসে গণমাধ্যমকে বলেন, ভোটে অনিয়ম হবে, এটা তিনি এখনো মনে করছেন না। আইজিপির ভাই প্রার্থী প্রসঙ্গে তাঁর কথা, ‘পুলিশপ্রধান অত্যন্ত সজ্জন, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক মানুষ। বিগত ছয় বছর আমাকে সহযোগিতা করেছেন। অত্যন্ত সম্মানজনক অবস্থানে রেখেছেন। তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট হোক, এমন চেষ্টা করা কারও কাম্য নয়।’
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মাহমুদ অবশ্য বলেছেন, ‘আমাকে জননেত্রী শেখ হাসিনা নৌকা দিয়েছেন। আমি তাঁর প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচন করছি। অন্য কারও পরিচয়ে নয়। আমি মনে করি, জয়া সেনগুপ্তার পক্ষ থেকেই আমার ভাইয়ের পরিচয়কে বেশি বেশি প্রচার করা হচ্ছে। যাতে আমি এবং আমার কর্মী-সমর্থকেরা বিব্রত হই।’
ভোটের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, এই দুই প্রার্থীকে নিয়ে দিরাই ও শাল্লায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও এখন বিভক্ত। এখান থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বারবার নির্বাচন করেছেন, সংসদ সদস্য হয়েছেন। সেটাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন জয়া সেনগুপ্তা। ২০১৭ সালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা যাওয়ার পর উপনির্বাচনে প্রথম সংসদ সদস্য হন জয়া সেনগুপ্তা। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আবার তিনি নৌকা নিয়ে সংসদ সদস্য হন। কিন্তু এবার তিনি নৌকা পাননি।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মাহমুদ শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং শাল্লা উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান। তাঁর বাবা প্রয়াত আবদুল মান্নান চৌধুরী শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
দিরাই শহরের আনোয়ারপুর এলাকায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়ি। এটাই উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। এখন জয়া সেনগুপ্তার কাঁচি মার্কার নির্বাচনী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বুধবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রাঙ্গণে কর্মী-সমর্থকদের জটলা। পাশেই ছাত্রলীগের উদ্যোগে নির্বাচনী কর্মী সভার আয়োজন চলছিল। সেখানে কথা হয় দিরাই পৌরসভার মেয়র বিশ্বজিত রায়ের সঙ্গে। খানিকটা উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা তো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই। কিন্তু নৌকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ভোট না দিলেও তারা পাস করবে। নৌকায় ভোট না দিলে ৭ তারিখের পর দেখে নেবে। এসব তো ভালো লক্ষণ না।’ উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের প্রবীণ আবদুল মান্নান বললেন, ‘সেন বাবুরে সব সময় ভোট দিছি। এখন জয়া সেনরে ভোট দিমু’
ছাত্রলীগের কর্মী সভায় যাওয়ার আগে কথা হয় জয়া সেনগুপ্তার সঙ্গে। এবার আপনার কাছে নৌকা নেই, ভোটাররা কীভাবে নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আওয়ামী লীগের বাইরে না। এই এলাকার ভোটাররা বহুদিন থেকেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে আছেন। এই সম্পর্ক সহজে ছিন্ন হওয়ার নয়। দলের সবাই আমার সঙ্গে আছে।’ ভোটে কোনো অনিয়মের আশঙ্কা আছে কি না এমন প্রশ্নে জয়া সেনগুপ্তা বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকজন বলে বেড়াচ্ছে আমরা ২০ হাজার ভোট বেশি পেলেও তারা জয়ী হয়ে যাবে। কেউ এটা বললে তো আমলে নিতে হয়।’
দিরাই শহরের থানা পয়েন্টের পূর্ব পাশে অপু তালুকদারের ছোট একটি চায়ের দোকান। সেখানে বসে গল্প করছিলেন নানা বয়সী কয়েকজন। জানতে চাইলে উপজেলার কার্তিকপুর গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ এক ব্যক্তি বললেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) তারাই সব। নেতারাই ছিল্লাইতাছে।’ আনোয়ারপুরের মধ্যবয়স্ক আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘ভোটও মানুষ যাইব।’ কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, দুই প্রার্থীই শক্তিশালী।
দিরাই শহর থেকে শাল্লা যেতে এখন প্রধান বাহন ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল। ১৯ কিলোমিটার ভাঙাচোরা, বিধ্বস্ত সড়ক, খাল-বিল-হাওর পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে যেতে বিকেল হয়ে যায়। শাল্লা সদর বাজারে নির্বাচনের আমেজ খুব একটা দেখা গেল না। বাজারের অলিগলিতে বেশি পোস্টার চোখে পড়ল নৌকার প্রার্থীর। ধামপুর গ্রামের আবদুল গণি (৬৫) বললেন, ‘আওয়াজ সদরে বেশি, গ্রামে কম।’ বাজারের গুদাম রোডে উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় এখন নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়। সেখানে থাকা গুপেন্দ্র চন্দ্র দাস (৫৪) বলেন, ‘আমরা বাপ-দাদার আমল থাকি নৌকা। নৌকা ছাড়া যাইত না।’
কলেজ রোডে কাঁচি মার্কার নির্বাচনী কার্যালয়। সেখান থেকে বেরিয়ে উপজেলা পরিষদের সামনে গিয়ে নৌকার প্রার্থী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মাহমুদের দেখা পাওয়া গেল। তিনি বললেন, ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনেক নির্বাচনে আমি সাথে ছিলাম। জয়া সেনগুপ্তার সঙ্গে থেকেও দুটি নির্বাচন করেছি। এই এলাকার মানুষ নৌকায় ভোট দিয়ে অভ্যস্ত। তারা নৌকায় ভোট দেবেই।’
শেয়ার করুন