২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় পুরো সিলেট তলিয়ে যাওয়ার পর দাবি ওঠে সিলেটের সুরমা নদী খননের। অব্যাহত দাবির মুখে ২০২৩ সালে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প পরিসরে সুরমা নদীর খনন কাজ শুরু হয়। ওই বছরেরই জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে চার মাসের এই কাজ শেষ হয়নি ১৫ মাসেও।
এ অবস্থায় আরেকটি বর্ষা মৌসুম সামনে। এবার বর্ষায় সিলেট ও সিলেটের উজানে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এমন হলে সিলেট আবারও বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতির কারণে নদী খননের পুরো টাকাই জলে যাচ্ছে। ১৫ মাসেও খনন কাজ শেষ না হওয়ায় এর কোনো সুফল পাবে না সিলেটবাসী। কারণ আসন্ন বর্ষায়ই পানির সাথে আবার পলি এসে জমবে নদীতে। ফলে আবার শুরু থেকে খনন কাজ করতে হবে।
তবে পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, নদীতে প্লাস্টিক পলিথিনসহ আবর্জনার স্তুপ জমে থাকায় বারবার খননযন্ত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে খনন কাজে দেরি হচ্ছে। আগামী জুনের প্রকল্পের পুরো কাজ সম্পন্নের আশা তাদের।
জানা যায়, ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে সিলেট নগরসহ জেলার প্রায় ৭০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি এই বন্যায় মাসখানেক দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। পলি জমে সুরমা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই সিলেটে বন্যা হয়ে যাচ্ছে বলে সে সময় জানান বিশেষজ্ঞরা।
এরপর পুরো সুরমা নদী খননের জোরালো দাবি ওঠে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সিলেট নগরীর কুশিঘাট থেকে বিশ্বনাথের দশগ্রাম পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয়। এই ১৫ কিলোমিটারের খনন কাজ ১৫ মাসেও শেষ হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, আগামী জুন পর্যন্ত তারা খননকাজ চালিয়ে যাবে। এর মধ্যে ১৫ কিলোমিটার খনন সম্পন্ন না হলেও যতটুকু কাজ হবে তা নিয়েই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে। এর মধ্যে অন্তত ৮০ ভাগ কাজ শেষ করতে চায় পাউবো।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যের কারণে খননকাজ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য নির্ধারিত সময়ে খননকাজ শেষ করা যায়নি। প্লাস্টিক ও পলিথিনের কারণে মেশিনারি যন্ত্রপাতি বিকল হয়। গত মৌসুমে ২০-২৫ মিনিট পরপর মেশিন পরিষ্কার করতে হয়েছে। তখন দফায় দফায় খননকাজ বন্ধ রাখতে হয়।
অবশ্য চলতি মৌসুমে দ্রুত খননকাজ এগিয়ে চলছে বলে জানান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কনফিডেন্স গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার আজিম উদ্দিন। তিনি জানান, বর্তমানে টুকেরবাজার ও জাঙ্গাইল এলাকায় খননকাজ চলছে।
এ বিষয়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ‘চলমান প্রকল্পটি আগামী জুন পর্যন্ত চালানো যাবে। এর মধ্যে শত ভাগ খননকাজ শেষ না হলেও অন্তত ৮০ শতাংশ শেষ হবে। দ্রুতগতিতে কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘সুরমার সিলেট অংশের কুশিঘাট এলাকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে, সেটি প্রকল্পের আওতাধীন। দুই-এক মাসের মধ্যে এই অংশে খননকাজ শুরু হবে। এখানে এক সঙ্গে সব ড্রেজার চালাতে হবে। এ জন্য সবশেষে কুশিঘাট এলাকা খনন শুরু হবে। প্রকল্পের মেয়াদ নতুন করে আর বাড়বে না।’
জানা যায়, গত ১১ বছরে সিলেটের সুরমা নদী খননে চারটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনাগুলো (ডিপিপি) মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর তিনবার সমীক্ষাও চালানো হয়। কিন্তু ওই প্রকল্পগুলোর কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ২০২৩ সালে ছোট পরিসরে যে একটি প্রকল্প চলছে তাও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি।
খনন কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় আগামী বর্ষায় সিলেটে বন্যা ও জলাবদ্ধতার আশঙ্কা প্রকাশ করে সিলেট পরিবেশ রক্ষা ট্রাস্টের আহ্বায়ক ডা. মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বলেন, সিলেটের মানুষ আশা করেছিল সুরমা নদী খননের মাধ্যমে নব্যতা ফেরানো হবে। কিন্তু নদী খননের কাজ লক্ষ্যমাত্রা থেকে বহুদূরে। নদী খনন নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নজরদারি না থাকায় প্রকল্পের ৫০ কোটি টাকা জলেই যাবে বলে মনে হচ্ছে। এতে সিলেটের মানুষ কোন সুফল পাবে না। উল্টো এবারও বন্যা দেখা দিতে পারে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, গত বছরের ২১ জানুয়ারি সুরমা নদীর খননকাজের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। সে সময় তিনি আসছে বর্ষার আগে খননকাজ শেষ হওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু বর্ষা শেষে হয়ে আরেক বর্ষা আসছে। অথচ কাজের অগ্রগতি খুব কমই হয়েছে। ধীরগতিতে এ খননকাজ চলছে।
তিনি বলেন, কেবল ১৫ কিলোমিটার নয়। পুরো সুরমা নদী খনন করতে হবে। না হলে সিলেটে বন্যা জলাবদ্ধতা কমবে না। কারণ পলি জমে পুরো নদী ভরাট হয়ে গেছে। উৎসমুখসহ নদীজুড়ে অসংখ্য চর পড়েছে। ফলে বর্ষায় বৃষ্টির পানি নদী দিয়ে নামতে পারে না। শহরে ঢুকে পড়ে।
খনন কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের বর্তমান এমপি ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ২০২২ সালের বন্যার পর দুটি প্রধান দাবি ছিল সুরমা খনন ও শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ। সে সময় প্রধানমন্ত্রী সিলেট এলে তাকেও এসব দাবি জানানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনটিরই কাজ সম্পন্ন হয়নি। যা খুবই হতাশাজনক।
শেয়ার করুন