
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনীতিতে দীর্ঘ তিন দশক সক্রিয় থাকার পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেন অ্যাডভোকেট শাহীনূর পাশা। সমালোচিত ও বিতর্কিত ডামি নির্বাচনে ‘সোনালী আশ’ প্রতীকে অংশ নিয়ে জামানত হারান তিনি। এরপর তৃণমূল বিএনপি ছেড়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে যোগ দেন গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর। বর্তমানে তিনি ওই দলের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির।
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে এবারো আলোচনায় সেই শাহীনূর পাশা। এ আলোচনা তার নির্বাচনি এলাকা সুনামগঞ্জ- ৩ (জগন্নাথপুর-শান্তিগঞ্জ) আসনে। কারণ এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক ৮ দলীয় নির্বাচনি সমঝোতা জোট।
এ জোটে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির শাহীনূর পাশা। তিনি ‘রিকশা প্রতীকে’ দলীয় প্রার্থী এখন। তাই জোটের টিকিট পেতে মরিয়া শাহীনূর।
তার পাশাপাশি আলোচনায় আছেন আরো দুই প্রার্থী। তারা হলেন, ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীকে জামায়াত প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াসীন খান, ‘দেয়াল ঘড়ি’ প্রতীকে খেলাফত মজলিসের যুক্তরাজ্য শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক শেখ মুশতাক আহমেদ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন শাহীনূর পাশা।
তার বারবার দলবদল, ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা করার মতো বিষয়গুলো জোটের ঐক্য ও ভাবমূর্তির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। তার বিরুদ্ধে আরো একটি গুরুতর অভিযোগ, ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই তৎকালীন ধর্মমন্ত্রীর বাসভবনে ‘শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষা’র নামে একটি সেমিনারে অংশ নেওয়া।
নিজের দলবদল ও ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে শাহীনূর পাশা চৌধুরী বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সর্বদা ফ্যাসিবাদি শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলাম। সে কারণে আমাকে গুমের হুমকি দেওয়া হয়।
যারা আমার দলবদল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের জানাতে চাই, এই পরিবর্তন কোনো ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য ছিলো না। বিগত ৩৫ বছরে জনগণের কাছে আমি যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছি। আমার ভোট ব্যাংক ষড়যন্ত্রকারীদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। গুম থেকে বাঁচতে এবং বৃহত্তর ইসলামি আন্দোলনের কৌশলগত প্রয়োজন হিসেবেই আমি ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জ- ৩ আসনে জামায়াত প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াসীন খান নির্বাচনি মাঠে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। সিলেট জজকোর্টের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর এই নেতা গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে ভোট চেয়ে গ্রামগঞ্জে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ- ৩ একটি মর্যাদাপূর্ণ আসন। জনগণ এখানে পরীক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব চায়। ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের প্রার্থী এবং জুলাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়ে ফ্যাসিবাদের পক্ষে যারা আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত ছিলেন তাদের দ্বারা এই আসনে জোটের পক্ষে ভালো ফল পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি আট দলীয় জোটের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, মাঠের বাস্তবতা ও ক্লিন ইমেজ বিবেচনা করে প্রার্থী দিলে জামায়াতের প্রার্থীকেই মনোনীত করতে হবে।
এ আসনে শেখ মুশতাক আহমেদও শক্তিশালী প্রার্থী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাঠে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং মাঠে প্রচুর সাড়া পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ- ৩ আসন উলামা- মাশায়েখ অধ্যুষিত এলাকা। এ আসনে আলেম-ওলামার একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। তাদের কাছে গ্রহনযোগ্য নয় এমন কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি বা প্রার্থী এ আসনে ৮ দলীয় জোটের মনোনয়ন পেলে নিশ্চিত ভরাডুবির শিকার হবে। তাই অবিলম্বে জনমত বিবেচনা করে এমন প্রার্থী দিতে হবে, যিনি বিভিন্ন দল মত ও সকল শ্রেণী- পেশার মানুষের ভোট আকর্ষণ করতে পারবেন।
এছাড়া জগন্নাথপুর উপজেলা শাখা জামায়াতের পেশাজীবী সংগঠনের সেক্রেটারি নেছাওর মিয়া এই পরিস্থিতিতে জোটের নেতৃত্বের দ্বিধা তুলে ধরে বলেন, জোটের শীর্ষ নেতৃত্ব এখন উভয় সংকটে। একদিকে শাহীনূর পাশা সাহেবের দলের পক্ষ থেকে জোর লবিং আছে অন্যদিকে অ্যাডভোকেট ইয়াসীন খান নিরলস কাজ করে মাঠের জনপ্রিয়তা অর্জন ও শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। তৃণমূলের কর্মীরা পরিষ্কার ইমেজকেই সমর্থন করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কেবল দলীয় কোটা পূরণ করলে হবে না, নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। সেই বিবেচনায় মাঠের জনপ্রিয়তা ও জনগণের আস্থাই হবে শেষ কথা। আশা করি, জোট সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।
খেলাফত মজলিস জগন্নাথপুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেনও একই সুরে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমাদের জোটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ এবং ফ্যাসিবাদি শক্তির পতন নিশ্চিত করা। এখানে ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বা দলীয় কোটার চেয়ে জনগণের আস্থা ও নির্বাচনের বিজয়ই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, তৃণমূল থেকে আসা রিপোর্টগুলো স্পষ্টতই ক্লিন ইমেজের প্রার্থীর দিকে ইঙ্গিত করছে। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে আশা করছি, ভোটের রাজনীতিতে যিনি পরীক্ষিত, তার প্রতিই জোটের সমর্থন থাকবে। এই পরিস্থিতিতে, বিতর্কিত প্রার্থীর প্রতি ঝুঁকে জোট কি নিশ্চিত ভরাডুবির ঝুঁকি নেবে নাকি তৃণমূলের দাবি মেনে ক্লিন ইমেজধারী প্রার্থীর হাতে তুলে দেবে বিজয় নিশ্চিত করার দায়িত্ব। সেদিকেই এখন তাকিয়ে আছে সুনামগঞ্জ- ৩ আসনের সাধারণ ভোটার ও রাজনৈতিক মহল।



