সেবা পেতে ১ বছরে ঘুষ ১০ হাজার কোটি টাকা!

জাতীয়

দেশের সেবা খাতে ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে দেখা যায়, ১ বছরে বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে দেশবাসীকে ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক টিআইবির এই জরিপে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন সেবা পেতে দেশের প্রতিটি পরিবারকে (খানা) গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। তারা ঘুষ দেন হয়রানি বা ঝামেলা এড়াতে। ঘুষের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থানায় আর ঘুষ নেওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ট্রাফিক পুলিশে।

বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জরিপের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সেবাগ্রহীতাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে করা এই জরিপে সারা দেশের ১৫ হাজার ৪৫৪টি খানা অংশগ্রহণ করে। জরিপের সময়কাল ছিল ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত।

জরিপে উঠে আসা দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে ঘুষ, জোরপূর্বক অর্থ আদায়, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, সময়ক্ষেপণসহ নানা হয়রানি।

জরিপের ফলাফল তুলে ধরে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত তিনটি হলো- আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে- থানা পুলিশ, র‌্যাব, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, সিআইডি, আনসার ইত্যাদি।

দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পাসপোর্ট সেবা। এরপর রয়েছে যথাক্রমে বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও ভূমিসেবা।
সেবা খাতের দুর্নীতির এই চিত্র উদ্বেগজনক। শুধু সেবা খাতের ‘পেটি করাপশনে’র মাত্রাই এত ব্যাপক, বড় প্রকল্প বা বড় কেনাকাটায় দুর্নীতির মাত্রা আরও বেশি বলেই ধারণা করা যায়।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

দেখা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা থেকে সেবা নিতে গিয়ে যেসব খানা (পরিবার) ঘুষ দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে তাদের গড়ে ৬ হাজার ৬৯৮ টাকা দিতে হয়েছে। তবে কেবল থানা পুলিশের হিসাব করলে ঘুষের পরিমাণ ৮ হাজার ৭০৯ টাকা। অর্থাৎ থানায় সেবা পেতে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ৮ হাজার ৭০৯ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে ট্রাফিক পুলিশকে। অর্থাৎ টাকার পরিমাণে কম হলেও ঘুষ গ্রহণের ঘটনা ট্রাফিক পুলিশে বেশি।

জরিপ বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১-এর নভেম্বর পর্যন্ত ১ বছরে সেবাগ্রহীতারা যে ঘুষ দিয়েছেন তার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। ১৭টি সেবা খাতে এই ঘুষ দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। হিসাব করে দেখা গেছে দেশের মানুষ মাথাপিছু ঘুষ দিয়েছে ৬৭১ টাকা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। তারা ঘুষ দেন হয়রানি বা ঝামেলা এড়াতে। খানাপ্রধানের প্রতিবন্ধিতা থাকলে দুর্নীতি ও ঘুষের শিকার হওয়ার প্রবণতা বেশি হয়। ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা কম দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৫৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সী নারী-পুরুষ।

সেবা গ্রহণকারী খানার মধ্যে ৫৫.৭ শতাংশ ঘুষ দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া অসদাচরণ ১১.৯ শতাংশ, থানা হাজত/প্রিজন ভ্যানে স্বাস্থ্যবিধি না মানার শিকার ১০ শতাংশ, ভয়-ভীতির শিকার ৮ শতাংশ, মিথ্যা মামলায় জড়ানো ৫ শতাংশ ও সাধারণ ডায়েরি বা এজাহার গ্রহণে অবহেলা বা সময়ক্ষেপণ ৪.১ শতাংশ, অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নেওয়া ৩.৬ শতাংশ ইত্যাদি অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

জরিপে উঠে এসেছে, দুর্নীতির শিকার হলেও অভিযোগ করেননি ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ অভিযোগ করেননি ঝামেলা বা হয়রানির ভয়ে। সবখানেই দুর্নীতি, তাই অভিযোগ করার প্রয়োজন বোধ করেননি ৪৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সাড়ে ১৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তবে ৭২ শতাংশ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জরিপে দেখা গেছে, সেবা গ্রহণকারী খানার মধ্যে ৫৫.৭ শতাংশ ঘুষ দিয়েছে বা দিতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া সেবা গ্রহণকারী খানাগুলো অসদাচরণ ১১.৯ শতাংশ, থানা হাজত/প্রিজন ভ্যানে স্বাস্থ্যবিধি না মানার শিকার ১০ শতাংশ, ভয়-ভীতির শিকার ৮ শতাংশ, মিথ্যা মামলায় জড়ানো ৫ শতাংশ ও সাধারণ ডায়েরি বা এজাহার গ্রহণে অবহেলা বা সময়ক্ষেপণ ৪.১ শতাংশ, অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা না নেওয়া ৩.৬ শতাংশ ইত্যাদি অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সার্বিকভাবে সেবা খাতে দুর্নীতি বেড়েছে। সেবা খাতের দুর্নীতির এই চিত্র উদ্বেগজনক। শুধু সেবা খাতের ‘পেটি করাপশনে’র (ছোট দুর্নীতি) মাত্রাই এত ব্যাপক। বড় প্রকল্প, বড় কেনাকাটায় দুর্নীতির মাত্রা আরও বেশি বলেই ধারণা করা যায়। দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা সরকারের কাছে রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেগুলোর প্রয়োগ দেখা যায় না। এই জরিপের ফলাফল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিবাচকভাবে নিয়ে দুর্নীতি কমাতে উদ্যোগ নেবে বলে আমরা আশা করি।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *