হাওরে কৃষকের হাসি : শ্রমিক সংকটে বিলম্বিত ধান কাটা

সুনামগঞ্জ

এমজেএইচ জামিল, সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে :
সুনামগঞ্জের হাওরে হাওরে হাসির ঝিলিক। সোনালি ধানে হাসছে হাওরগুলো। চারদিকে এখন উৎসব মুখর পরিবেশে ধান কাটা চলছে। আবহাওয়া জনিত স্বস্তি থাকলেও শ্রমিক সঙ্কটে ব্যাহত হচ্ছে ধান কাটা কার্যক্রম। জেলা জুড়ে ১ হাজারেরও বেশী হারভেস্টার (ধান কাটার মেশিন) ধান কাটার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। পাশাপাশি হাতে ধান কাটছেন শ্রমিকরা। এরপরও পর্যাপ্ত শ্রমিক না থাকায় বিলম্বিত হচ্ছে দ্রুত ধান তোলার কাজ।

এদিকে আগাম বন্যা ও করোনা সংক্রমণের কারণে বোরো আবাদে গত দুবছর ক্ষতির সম্মুখীন ছিলেন হাওরপারের কৃষক। তাই সব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ বছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলিয়েছেন সোনালী ধান। আর বাড়তি যত্নের কারণে ফলনও হয়েছে মোটামুটি ভালো। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলার কৃষি বিভাগ। এদিকে অতিরিক্ত ঝুঁকি এড়াতে পাকা ধান দ্রুত কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন সকল কৃষক।

সরেজমিনে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) উপজেলার সাংহাই হাওর, ডেকার হাওর (দেখার হাওর), দামাইর হাওর ঘুরে ও স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হাওরের খলায়-খলায় এখন ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও সিদ্ধ করার কাজ পুরোদমে চলছে। ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক-কৃষাণীরা। হাওরের জমির পুরোটাই এক ফসলি। এই ফসলের আয় থেকেই কৃষক সারা বছরের খাওয়া-পরা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সামাজিক অনুষ্ঠান– সবকিছু চালায়। তাই ফসল কাটার সময় হলে পরিবারের বাইরে থাকা সদস্যরাও বাড়ি ফিরে আসেন। দিনে ধান কাটা, শুকানো আর রাতভর উঠানে গৃহিণীরা ধান সিদ্ধ করেন। বাড়ি ভর্তি থাকে ‘নাইয়া’তে (বাইরে থেকে আসা শ্রমিক)।

কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এবার মাঘ-ফাল্গুন মাসে অনাবৃষ্টির কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। চৈত্র মাসের শুরুতে বৃষ্টির দেখা পাওয়ায় প্রাণ ফিরে পায় বোরো ধান। কৃষকের মুখে ফুটে হাসি। ফলে বৈশাখের শুরুতে হাওরে ধান কাটা শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে ২য় সপ্তাহ থেকে একসাথে সকল হাওরে শুরু হয় ধান কাটা। তখন হারভেস্টার মেশিন (ধান কাটার মেশিন) গুলোতে বাড়তি চাপ পড়ে। বিভিন্ন এলাকায় পর্যাপ্ত হারভেস্টার না থাকায় এবং চাহিদমতো শ্রমিক না আসায় বিলম্বিত হয় ধান কাটা।

বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) পর্যন্ত সুনামগঞ্জে ৯০ ভাগ বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে এবং ৭৪ ভাগ ধান ইতোমধ্যে কৃষকের ঘরে উঠেছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস। এখন পর্যন্ত আগাম বন্যা ও অতিবৃষ্টি জনিত শঙ্কা না থাকায় আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে হাওরের শতভাগ ধান কাটা শেষ হবে বলে জানিয়েছে কৃষি অফিস।

ডেকার হাওর (দেখার হাওর) এর কৃষক রফিক মিয়া বলেন, এবার খরার মধ্যেও শেষ সময়ে বৃষ্টি হওয়ায় মোটামুটি ভালো ফলন হয়েছে। তবে অতিরিক্ত খরচের কারণে আমরা ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছি। তিনি বলেন, শ্রমিক সঙ্কটের কারণে বর্তমানে এক মণ ধানে একজন কামলা খাটাতে হচ্ছে। এক মণ ধান উৎপাদনে হাজার টাকার বেশি খরচ পড়ে। কিন্তু সেই ধান এখন ৮০০ টাকা করে বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ এ ধান যদি মণপ্রতি ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা হতো, তাহলে কৃষকেরা কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পারতেন।

ধামাইর হাওরের কৃষক বজলু মিয়া জানান, ১ কেদার জমি অর্থাৎ ২৮ শতাংশ জমির ধান কাটতে শ্রমিকদের দিতে হয় ৩ হাজার টাকা আর সেই ধান নিতে আরও গাড়িভাড়া লাগে ২ হাজার টাকা। মোট ৫ হাজার টাকা খরচ। ধানের ভালো ফলন হলে কেদার ১৮ মণ থেকে ২০ মণ ধান পাওয়া যেত, কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে কেদারপ্রতি ১২ থেকে ১৫ মণ ধান পাচ্ছেন।

সাংহাই হাওরের কৃষক আব্দুর রউফ মিয়া জানান, সাংহাই হাওরে ১ কেদার (৪২ শতাংশ) জমি কাটতে হারভেস্টর মেশিনকে দিতে হচ্ছে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা। তারপর জমি থেকে ধান খলায় নিতে ট্রলি/ট্রাক্টর বাবদ কেদারপ্রতি খরচ হচ্ছে ১ হাজার টাকা। এর আগে হাল চাষ, বীজতলা নির্মাণ, চারা রোপন, সার প্রয়োগ ও সেচপাম্প বাবদ কেদারপ্রতি আরো ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে এক কেদার জমিতে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ করে ধান উৎপাদন হচ্ছে কেদারপ্রতি গড়ে ১২ থেকে ১৫ মণ। যার বর্তমান বাজারমূল্য ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। এরমধ্যে কৃষক ও তাদের পরিবারের শ্রম তো আছেই। প্রযুক্তির কারণে যে হারে খরচ বাড়ছে সেই হারে ধানের মূল্য বাড়ছেনা।

জেলার বিভিন্ন উপজেলা প্রতিনিধিগন জানান, সুনামগঞ্জের হাওরে ধান কাটতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কৃষক। এই সময়ে অবসর বা দম ফেলার ফুসরত নেই তাদের। ২ লক্ষাধিক পুরুষ শ্রমিক ও ১ হাজার হারভেস্টার মেশিনে ধান কাটলেও খলায় ধান শুকানোসহ গোলায় তোলার জন্য ধান প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করছেন নারীরা। হাওর ঘুরে দেখা গেছে, কৃষক পরিবারের নারী পুরুষের শ্রমেই সুনামগঞ্জে এবার ৩ হাজার ৮শ কোটি টাকার ধান গোলায় উঠছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে। আবাদকৃত জমিতে ধান উৎপাদানের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লক্ষ ৫৩ হাজার মে. টন। যা চালের পরিমাণে দাড়ায় ৯ লাখ ২ হাজার মে. টন। আর টাকার অংকে প্রায় ৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা।

জেলায় মোট ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার কৃষক পরিবার রয়েছে। এই পরিবারগুলো সরাসরি হাওরে ধান চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা জমিতে বীজ বপন, রোপন ও ধান কাটাতে কাজ করেন। অপরদিকে পরিবারের নারী সদস্যরা, গবাদিপশুর জন্য খড় শুকানো, খলায় ধান শুকানো, উড়ানোর (ছাটা হওয়া ধান আলাদাকরণ) কাজসহ গোলায় তোলার প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করছেন। শেষ সময়ে এসে হাওরপার জুড়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।

এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জ জেলার উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) পর্যন্ত জেলায় ৯০ শতাংশ ধান কাটা ও ৭৪ শতাংশ ধান ঘরে তোলা শেষ হয়েছে। এবার জেলায় ৭৬৫টি হারভেস্টর এবং জেলার বাইরে থেকে আরো ২৬০টি হারভেস্টর ধান কাটার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাই কৃষকদের মাঝে স্বস্তি বিরাজ করছে। আশা করছি আগামী ৩/৪ দিনের মধ্যে সকল হাওরের শতভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হবে। ৫/৬ দিনের মধ্যে সব ধান ঘরে তোলা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাতের পূর্ভাবাস থাকলেও ভারী বর্ষণের আভাস নেই। তাই কৃষকদের যত দ্রুত সম্ভব ধান কাটা শেষ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *