অভূতপূর্ব এক মুহূর্ত। একমঞ্চে তাহসান, জন, টনি, জাহান ও মিরাজ। কেউ কি কখনও ভেবেছিলেন আবারও একসঙ্গে দেখা যাবে ‘ব্ল্যাক’ ব্যান্ডের পুরনো এই সদস্যদের? শূন্য দশকে ব্যান্ডটির ভাঙন ছিল আলোচিত এক ঘটনা। ২০০৫ সালে ব্যান্ড ছেড়ে দেন তাহসান। এরপর ব্ল্যাকের হাল ধরেন জন। কিন্তু সময়ের আবর্তে ব্যান্ড থেকে সরে যান ড্রামার টনি ও বেজিস্ট মিরাজ। ২০১২ সালে এসে জনও ঘোষণা দেন নতুন ব্যান্ড ‘ইনদালো’ নিয়ে পথচলার।
ভাঙা-গড়ার এই খেলায় ভক্তদের মনে ব্যান্ডটির ভবিষ্যৎ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে! অধিকাংশই ভেবেছিলেন ব্ল্যাকও অন্ধকারে চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে! আর ফিরবে না! কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় ব্যান্ডটির নতুন অ্যালবাম ‘উনোমানুষ’। এরই মধ্যে ভোকালিস্ট হিসেবে আশিফুর, মাশুক, রুবায়েতকে নিয়ে কয়েক দফায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে দলটি। কিন্তু কেউই স্থায়ী হননি বেশিদিন। বর্তমানে ভোকালিস্ট ইশানকে নিয়েই চলছে ব্ল্যাকের গান-বাজনা। কিন্তু সম্প্রতি একটি ছোট্ট ভিডিওবার্তায় চমকে যায় ব্ল্যাক-ভক্তরা। প্রথম লাইনআপে একসঙ্গে পারফর্ম করার ঘোষণা দেন তাঁরা। জানা যায়, নতুন গান ‘সমান্তরাল’র মিউজিক ভিডিও প্রকাশের দিনই একমঞ্চে গাইবেন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যরা। এ ঘোষণায় হইচই পড়ে যায় অনুরাগীদের মাঝে। অবশেষে শুক্রবার (১০ মে) তেমনই এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হন প্রায় ১৫ হাজার দর্শক-শ্রোতা। সাম্প্রতিক সময়ে এত দর্শক সমাগমও বিরল ঘটনা। শুধু ব্ল্যাকে টানেই এই জমায়েত। ব্ল্যাক ফরেভার!
‘রক এন রিদম ৪.০: রিজারেকশন অব ব্ল্যাক’ শিরোনামে এই কনসার্টের ভেন্যু ছিল রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার বসুন্ধরার এক্সপো জোন। ওপেন এয়ার কনসার্ট। যেখানে ব্ল্যাক ছাড়াও পারফর্ম করেছে ক্রিপটিক ফেইট, মিজান রহমান, অনি হাসান, ওল্ড স্কুল, ফারুক ভাই প্রজেক্ট, রিকল ও পপাই। কনসার্টের এই লাইনআপও ছিল শ্রোতাদের কাছে আকর্ষণীয়।
বেলা ৩টার দিকে শুরু হয় কনসার্ট। চমকের শুরু প্রথম থেকেই। দীর্ঘদিন পর কনসার্টে পারফর্ম করে ‘ওল্ড স্কুল’। লালনের ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’সহ ‘নিখোঁজ ঈশ্বর অথবা এক বন্ধুর খোঁজে’, ‘আজ রাতে কোনো রূপকথা নেই’ প্রভৃতি গানগুলো। এরপরই মঞ্চে উঠেন ফারুক ভাই। তিনি গেয়েছেন ‘কামিনী’, ‘নাচ বাঙালি নাচ’, ‘দুইটা দেখি’সহ কয়েকটি গান।
দর্শক অবশ্য তখনও খুব বেশি ছিল না। কিন্তু বেলা যত গড়িয়ে যায়, ততই বাড়তে থাকে হেডব্যাঙ্গারদের ভিড়। বিকেলের মধ্যেই পুরো মাঠ পরিণত হয় জনঅরণ্যে। একপর্যায়ে মঞ্চে ওঠে ‘রিকল’ ব্যান্ডের সদস্যরা। তাঁরা পারফর্ম করেন ‘যদি’, ‘প্রেম সমাচার’সহ কয়েকটি গান। এরপরই দেখা দেন ‘পপাই’। তখন সন্ধ্যা নামছে বলে! ‘বিষন্ন সুন্দর’, ‘ভালোবাসা বাকি’, ‘তিক্ত সত্য’, ‘নেশার বোঝা’, ‘রাতের কথা’র মতো জনপ্রিয় গানগুলো গেয়েছেন তাঁরা। পপাইয়ের সুরে কণ্ঠ ধরেন আগত দর্শকরা।
সন্ধ্যার পরই মঞ্চে দেখা মেলে ক্রিপটিক ফেইটের সদস্যদের। ‘চলো বাংলাদেশ’, ‘আক্রমণ’, ‘ভবঘুরে’সহ বেশকিছু গান। গিটার আর ড্রামসের তালে গানের মোহনায় মগ্ন হতে থাকেন শ্রোতারা। এরপর থেকেই বিশেষ চমকের শুরু।
দীর্ঘ ১০ বছর পর দেশের মঞ্চে পারফর্ম করেন গিটারিস্ট অনি হাসান। তাঁর সঙ্গে ভোকালিস্ট হিসেবে যোগ দেন মিজান রহমান। কি-বোর্ডে ছিলেন রোমেল আলি। ছিলেন পাওয়ারসার্জ ব্যান্ডের ভোকালিস্ট জামশেদ। সবাইকে নিয়ে পুরনো দিনে ফিরে যান অনি। নস্টালজিয়ায় ডুব দেন শ্রোতারাও। মিজান আর রোমেলকে নিয়ে ওয়ারফেজের ‘না’ ও ‘পূর্ণতা’ গান দুটি পারফর্ম করেন অনি। আর জামশেদ গেয়েছেন ভাইব ব্যান্ডের ‘স্বপ্নদেব’ ও ‘অধরা’ গান দুটি। এ যেন ওয়ারফেজ, ভাইব ও পাওয়ারসার্জ মিলেমিশে একাকার। মাঝেমধ্যেই পুরনো ব্যান্ডের স্মৃতিচারিয়ায় মজেছেন মিজান-অনি।
ঘটেছে বিশেষ একটি ঘটনাও। অনি যখন দশ বছর আগে দেশে ছিলেন, তখন জীবিত ছিলেন রক কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু এরইমধ্যে পদ্মা-মেঘনায় অনেক জল গড়িয়েছে। প্রয়াত হয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। কিন্তু একবার যিনি এমন কীর্তিমান মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন, তিনি কি তাঁকে ভুলতে পারেন? না, তা সম্ভব নয়। তাঁর স্মরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়েছেন অনি। বাজিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ গানটির সলো। অনি বলেন, ‘হি ইজ মাই গিটার হিরো।’
দর্শকরা এরইমধ্যে গানে ডুবে গেছেন! মঞ্চে দেখা দিলেন এ কে রাহুল ও ব্ল্যাক ব্যান্ডের বর্তমান সদস্যরা। তাঁদের উপস্থিতিতে প্রিমিয়ার হয় ‘সমান্তরাল’ গানটির ভিডিওচিত্র। এরপরই ইশানকে নিয়ে মঞ্চে উঠে ব্ল্যাক। তাঁরা ‘আবারও’, ‘মানুষপাখির গান’, ‘তুমি কি সাড়া দিবে’সহ কয়েকটি গান পারফর্ম করেন। তারপরেই মূল চমকের শুরু। মঞ্চে আসেন এই বিশেষ কনসার্টের বিশেষ মানুষেরা। দর্শকদের দেখা দেন জন, তাহসান ও টনি। এবার শুরু তাঁদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। দর্শক শ্রোতারাও যেন এ সময় নস্টালজিক। জন শুরুটা করেন ‘আমরা’ গান দিয়ে। তারপর তাহসান গেয়ে উঠেন ‘শ্লোক’। কথা আর পারফরম্যান্সের শৈল্পিকতা উপভোগ করতে থাকেন সবাই। তাহসানের কণ্ঠে কখনও র্যাপ গান শুনেছেন? জনকে দেখেছেন ড্রামস বাজাতে? কিংবা টনি যখন ভোকালিস্ট। দর্শকদের এমন দারুণ কিছু মুহূর্ত তাঁরা উপহার দিয়েছেন। তাহসান গেয়েছেন ‘প্রাকৃতিক’। এ গানের র্যাপ ভার্সনটি তাঁরই গাওয়া। সব মিলিয়ে, বেশকিছু গান করেছে ব্ল্যাক। ‘আমার পৃথিবী’, ‘কবর’, ‘কেন’, ‘যদি ইচ্ছে করে তবে’সহ অনেক গান।
আসলে এ কনসার্টে দর্শকরাও ছিলেন নস্টালজিক। একমঞ্চে তাহসান, জন ও টনিকে পেয়েছেন, যা তাঁদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তাহসানের পিয়ানোতে বসে গায়তে দেখেছেন জনকে! এমন কিছু দুর্দান্ত মুহূর্ত শ্রোতাদের জন্য নিশ্চয় অবিস্মরণীয়। বিকেলের দিকে কনসার্ট শুরু হলেও তা যখন শেষ হয়েছে, তখন রাত ১২টা ছুঁইছুঁই। মাঠে তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত নেই! এমন দারুণ একটি কনসার্টের জন্য আয়োজক প্রতিষ্ঠান অ্যাডভেন্টর কমিউনিকেশনও ধন্যবাদ প্রাপ্য। তবে যা হয় আরকী, বিচ্ছিন্ন কিছু দুর্ঘটনাও রয়েছে। যেন দর্শকদের মধ্যে মারামারি, গণ্ডগোল এসবও ছিল। তবে শেষ অবধি ভক্তরা ডুব দিতে পেরেছেন সুরের ‘ব্ল্যাক হোলে’।