সিলেটে লুটপাট করা জব্দকৃত বালুর বাজার মূল্য ৭০ থেকে ৭৫ টাকা থাকলেও তা ২টাকা ধরে নিলাম করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এই নিলামের পেপারস ব্যবহার করে আবারো বালু লুটপাটের সকল প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। সব কিছু চোখের সামনে হলেও সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক কয়েস আহমদের ভয়ে প্রশাসনের কেউ মুখ খুলছেন না। নিরুপায় হয়ে নিলামে অংশ নিতে না পারা এক ব্যবসায়ী দুদকের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন। বিষয়টি নিয়ে সিলেটজুড়ে তোলপাড় চলছে।
নবাব শায়েস্তা খাঁ'র কথা আমরা সবাই শুনেছি। মোগল আমলে বাংলার একজন খ্যাতিমান শাসক ছিলেন তিনি। কথিত আছে, তার শাসনামলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। সিলেটে বালুমহাল থেকে জব্দ করা বালুর সরকারি নিলাম ডাকের দর অনেকটা সেই শায়েস্তা খার আমলকে মনে করিয়ে দেয়। ৫০ থেকে ৭৫ টাকা ঘনফুট দরের বালু সরকারি নিলাম ডাকে মাত্র দুই টাকা ফুট দরে বিক্রি করা হয়েছে। বালুর এ দরকে বলা হচ্ছে, ‘শায়েস্তা খার দর’। এতে সরকারের অন্তত ১৩ কোটি টাকা গচ্ছা গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, একটি সিন্ডিকেটের প্রভাবে একতরফা বালুর বাজারদরের সঙ্গে আকাশ-পাতাল ফারাক রেখে নিলাম ডাক সম্পন্ন করা হয়। দুই টাকা ফুট দরে বালু কিনেছেন সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক কয়েস আহমদ। নিলামে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেটের একটি অংশের যোগাসাজশে বালুর দর দুই টাকায় নামিয়ে এই নিলাম সম্পন্ন করা হয়।
রোববার তড়িগড়ি করে ৬ মাসের সময় দিয়ে বালুর ক্রেতাকে ওয়ার্ক ওয়ার্ডার দেওয়ার কথা। আর এই দুর্নীতি বন্ধ করতে শনিবার দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন কয়েস সিন্ডিকেটের প্রভাবে নিলামে অংশ নিতে না পারা মোঃ এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া।
সরকারি নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও জকিগঞ্জ, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বালুমহাল বহির্ভূত এলাকা থেকে জব্দ করা বালুসহ বিভিন্ন পণ্যের প্রকাশ্য নিলাম ডাক সম্পন্ন হয় ১৯ নভেম্বর। এর মধ্যে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৯৯৬ ঘনফুট ও ১১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৯৯ ঘনফুট বালুর নিলাম ডাক হয়। বালুর বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রায় ১৩ কোটি টাকার বালুর নিলাম ডাকে অংশ নেওয়ার কথা ছিল ৯ জন ব্যবসায়ীর। কিন্তু নিলাম ডাকের সময় অনুপস্থিত থাকেন আটজন। অংশ নেন কেবল কয়েস আহমদ নামের একজন।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নিলাম ডাকের প্রথম বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বালুর দর প্রতি ফুট সাড়ে ৯ টাকা ডাক উঠেছিল। বাজারদরের সঙ্গে অসামঞ্জস্য থাকায় তখন দাম বাড়াতে দ্বিতীয় দফা নিলাম ডাক আহ্বান করা হয়।
গত ২২ অক্টোবর সেই নিলাম ডাকের নথি থেকে জানা গেছে, ৯ জন ব্যবসায়ী অংশ নেন। সর্বোচ্চ দর ছিল সাড়ে ৯ টাকা। বাকিরা কোনো দর হাঁকাননি। দ্বিতীয় দফায় এসে দর নামে ৭ টাকা ৬০ পয়সা। সর্বশেষ দুই টাকা ৬৮ পয়সা।
নিলাম সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বালু ৩৮ লাখ টাকায় বিক্রি করে নিলাম ডাকের মধ্যে সরকারের প্রায় ১৩ কোটি টাকা গচ্চা গেছে।
জানা গেছে, নিলাম ডাকে শায়েস্তা খার দর ঢাকতে দ্রুত সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়ে ওয়ার্ক ওয়ার্ডার গ্রহণপূর্বক নিলামের বালু অপসারণ তথা ক্রেতার হেফাজতে নিতে ছয় মাস সময় চেয়ে আবেদন করেছে। প্রথম দফার নিলামে অংশ নেওয়া বালু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছয় মাসের আবেদন মঞ্জুর হলে নিলামের বালু অপসারণের নামে বালু আহরণপূর্বক পুরো নিলাম ডাকের সমপরিমাণ বালু আহরণে সক্রিয় রয়েছে সিন্ডিকেটটি। এতে করে ১৩ কোটি টাকার বালুর সঙ্গে আরও প্রায় দ্বিগুণ বালু মিলিয়ে সরকারের প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার বালু লুটের তৎপরতা চলছে।
এদিকে, সরকারি নিলাম ডাকে বালু বিক্রির বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বালুর ফুট ২ টাকা! আহারে সিন্ডিকেট! ১৩ কোটি টাকার বালু মাত্র ৩৮ লাখ টাকায় বিক্রি?’ এমন প্রশ্ন রেখে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন সচেতন অনেকই। জব্দের বালুর নিলাম ডাকে ‘শায়েস্তা খার দর’ বিষয়টি ফেসবুকে আলোচিত হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে সিলেটের চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নিলাম কমিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা (নাজির) ফাইজুল ইসলামের ব্যাবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভি করেননি।
আর সিন্ডিকেটের মূলহোতা সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক কয়েস আহমদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনেও একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দিলেও তিনি বক্তব্য প্রদান করেননি।
উল্লেখ্য, যুবদল নেতা কয়েস আহমদ গত বছর ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুরো আদালত পাড়ায় নিয়ন্ত্রণ গড়ে তুলেছেন। বিপ্লবের পর থেকে এপর্যন্ত যত নিলাম হয়েছে সব তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই হয়েছে। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিএনপি ও দলটির সিনিয়র নেতাদের নামে আদায় করে থাকেন এই কয়েস। তার কাছে এখন রীতিমতো সবাই অসহায়।
প্রধান সম্পাদকঃ সারওয়ার খান
সম্পাদকঃ জাকের খান (রুবেল)
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৫