‘টু-লেট’ লেখা সাইনবোর্ডে সয়লাব সিলেটের অভিজাত উপশহর এলাকা। ছবি:
গাছটির গোড়া থেকে প্রথম ১০-১২ ফুটের প্রায় পুরোটাই ঢেকে ফেলা হয়েছে ছোট ছোট কাগজে। গাছে পেরেক দিয়ে লাগানো লেমিনেটিং করা এসব কাগজে লেখা রয়েছে, ‘বাসা ভাড়া দেওয়া হবে’। কোথাও ইংরেজিতে লেখা ‘টু-লেট’।
সিলেট নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকায় ঢুকে বাম পাশের প্রথম গাছটিতেই দেখা গেল এমন দৃশ্য। এরপর পুরো এলাকা ঘুরেই একই দৃশ্যের দেখা মিলল। বিশাল এ এলাকার প্রায় সব গাছেরই শরীরজুড়ে বাসাভাড়ার
এলাকাটির বিভিন্ন বাসার ফটকের সামনেও ঝোলানো রয়েছে এমন বিজ্ঞাপন।
শাহজালাল উপশহর সিলেটের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত। ১৯৮২ সালে নগরের আবাসন সমস্যা নিরসনে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ১৮৮ একর আয়তনের হাওর ভরাট করে নির্মাণ করে এ আবাসিক এলাকা। এখানে ১০টি ব্লকে দুই হাজারের কাছাকাছি প্লট রয়েছে। এখানকার ভবনগুলোতে অন্তত ২৫ হাজার মানুষের বসবাস।
নগরের বিত্তশালীদের অন্যতম পছন্দের এলাকা উপশহর। এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে আলিশান একেকটা বাড়ি। ভাড়াটিয়াদের কাছেও পছন্দের ছিল অভিজাত এ এলাকা। আগে বাসা বা ফ্ল্যাট খালিই পাওয়া যেত না এখানে। উচ্চ ভাড়ায় থাকতেন ভাড়াটিয়ারা, কিন্তু হঠাৎ কেন বদলে গেল চিত্র? কেন বেশির ভাগ বাসার ফটক আর গাছে গাছে ঝুলছে বাসাভাড়ার বিজ্ঞাপন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন সুলেমান আহমদ। শাহজালাল উপশহর এলাকার ডি ব্লকে তিনতলার একটি বাসা আছে সুলেমানের। তার বাসার সামনেও ঝুলছে ‘টু-লেট’ সাইনবোর্ড। তিন মাস ধরে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখলেও মিলছে না ভাড়াটিয়া।
কেন এমনটি হচ্ছে জানতে চাইলে সুলেমান বলেন, চলতি বছর কয়েক দফা বন্যার পর থেকেই এমনটি হচ্ছে। বন্যা ও ভারি বৃষ্টিতে পুরো এলাকা ডুবে যায়। বাড়িঘরেও পানি ওঠে। তাই বন্যার পর নিচতলার সব ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। এখন আর নতুন ভাড়াটিয়া মিলছে না।
তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের কোনো বাসার ফ্ল্যাটই খালি থাকত না। গত তিন মাস ধরে নিচতলার দুটি ফ্ল্যাটই খালি পড়ে আছে।’
গত এপ্রিল ও জুনে সিলেটে দুই দফায় বন্যা হয়। জুনে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে যায় জেলার ৮০ শতাংশ এলাকা। তখন নগরের অনেক এলাকা ১৫ দিন পর্যন্ত তলিয়ে ছিল।
এর আগে এপ্রিলের বন্যায়ও জলমগ্ন ছিল নগরের বেশির ভাগ এলাকা। নিচু এলাকাগুলোতে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে।
বন্যার পর ১৭ জুলাই ও ৫ সেপ্টেম্বর বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় নগরে। নিচু এলাকাগুলোর বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়ে পানি। নগরের সবচেয়ে নিচু এলাকার একটি শাহজালাল উপশহর। দুই দফা বন্যায় হাওর ভরাট করে বানানো এই আবাসিক এলাকার ৯৭টি সড়ক ডুবে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়। দীর্ঘদিন বাসায় পানি জমে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহান বাসিন্দারা। জলাবদ্ধতার সময়ও এই এলাকার প্রায় সব বাসায় পানি ঢুকে যায়।
বারবার এই দুর্ভোগে অতিষ্ঠ উপশহরের অনেক ভাড়াটিয়া গত বন্যার পর এলাকা ছাড়তে শুরু করেন। এখানকার বাসাগুলোর নিচতলার বেশির ভাগ ভাড়াটিয়াই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানান মালিকরা। নিচতলার জন্য নতুন ভাড়াটিয়াও পাচ্ছেন না তারা।
উপশহরের বি ব্লকের একটি বাসার ভাড়াটিয়া ছিলেন নিশাত আহমদ। মাসদুয়েক আগে ওই এলাকা ছেড়ে তিনি শিবগঞ্জ এলাকার নতুন বাসায় উঠেছেন।
নিশাত বলেন, ‘বন্যার সময় ঘরের পুরোটাই প্রায় পানির নিচে ছিল। বন্যায় দুই দফা আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। পানি ও বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন। পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকায় পরিবার নিয়ে অন্যত্র যাওয়ারও সুযোগ ছিল না।
‘এই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে উপশহর এলাকা ছেড়েছি। এখন অনেকটা পথ ঘুরে বাচ্চার স্কুল ও নিজের অফিসে যেতে হয়। তবু পানির দুর্ভোগ থেকে নিস্তার মিলেছে।’
এদিকে নতুন ভাড়াটিয়া না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন অনেক বাসার মালিক। বিশেষত যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাসা করেছেন, তারা পড়েছেন সংকটে।
উপশহরের ‘সি’ ব্লকের ৩৭ নম্বর সড়কে ব্যাংকঋণ নিয়ে বছর চারেক আগে বাড়ি নির্মাণ করেন লিয়াকত আলী।
তিনি বলেন, ‘বাসা ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত টাকা থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করি, কিন্তু গত দুই-তিন মাস ধরে নিচতলায় ভাড়াটিয়া নেই। ফলে কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছি।’
সরকারি এ আবাসন প্রকল্প অপরিকল্পিতভাবে তৈরির ফলেই এমন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ তার।
শাহজালাল উপশহরের অবস্থান সিলেট নগরের ২২ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সালেহ আহমদ সেলিমও জানান, বন্যার পর এলাকার অনেক ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।
তিনি বলেন, ‘বন্যা এবার সবাইকে ডুবিয়েছে। টাকা দিয়ে কেউই দুর্ভোগ কিনতে চান না। এ জন্য পানি নামার পর অনেকেই উপশহরের বাসা পরিবর্তন করেছেন।’
কাউন্সিলর সালেহ বলেন, ‘উপশহরের ড্রেনেজ-ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সুরমা নদী খনন ছাড়া এই দুর্ভোগ থেকে নিস্তার মিলবে না।’
শুধু উপশহর নয়, একই অবস্থা নগরের তেররতন, যতরপুর, সোবহানীঘাট, কুশিঘাট, ছড়ারপাড়, মাছিমপুর, জামতলা, শেখঘাট, মোল্লাপাড়া, ঘাসিটুলা, খুলিয়াপাড়া, মোগলটুলা, তালতলাসহ অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলোর।
এসব এলাকারও অনেক বাসার সামনে ‘টু-লেট’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলছে। অনেক ভাড়াটিয়া ইতোমধ্যে বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। যারা এখনও ছাড়তে পারেননি, তারা নতুন বাসা খুঁজছেন। আর এতে করে লোকসানে পড়েছেন ভবন মালিকরা।
ঘাসিটুলা এলাকার ভবনমালিক রাইসুল ইসলাম বলেন, ‘সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নকশা অনুমোদন করিয়েই বাসা বানিয়েছি। পানি ওঠার ঝুঁকি থাকলে তারা আগে জানাতে পারত। তাহলে আরও উঁচু করে বানাতাম। এখন বাসা বানিয়ে বিপাকে পড়েছি। ভাড়াটিয়া পাচ্ছি না। বিক্রিও করতে পারব না।’
সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নদী ও ড্রেন ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে দাবি তার।
সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে জানান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, বন্যার থেকে মুক্তির জন্য সুরমা নদী খনন করতে হবে। নগররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ ব্যাপারে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘অতিবৃষ্টিতে সিলেটের চা-বাগানগুলোর টিলা ধসে পড়ে। এতে টিলা থেকে নেমে আসা ছড়াগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ফলে ছড়া উপচে পানিতে নগর তলিয়ে যায়।
‘এখন ছড়াগুলো খনন ও পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার, কিন্তু এসব ছড়ার মালিকানা জেলা প্রশাসনের। তাদেরই এসব ছড়া পরিচ্ছন্ন করতে হবে।’