সিলেটে সড়ক যেনো লাশ কাটা ঘর

সিলেট

সিলেটে সম্প্রতি ভয়াবহ হারে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই সিলেট বিভাগের সড়ক-মহাসড়কে ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। কোনো দুর্ঘটনায় যাচ্ছে একাধিক প্রাণ। মেনে নিতে হচ্ছে বীভৎস মৃত্যুর নিয়তিকে, রাস্তায় পড়ছে থাকছে মানুষের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন নিথর শরীর। অনেকে আবার সারা জীবনের জন্য সঙ্গী করছেন পঙ্গুত্বকে। সিলেটের সড়ক-মহাসড়ক মানুষ চলাচলের পথ নয়, যেন লাশ কাটা ঘর।

সর্বশেষ শুক্রবা (১১ নভেম্বর) সিলেট বিভাগে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিকসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও চারজন।

শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় চলন্ত মোটরসাইকেলের ওপর গাছ পড়ে বিক্রমজিৎ বর্ধন নামের এক সাংবাদিক মারা গেছেন। এ সময় সঙ্গে থাকা তাঁর বড় ছেলে জয় বর্ধন আহত হয়েছেন। উপজেলার মোকামবাজার এলাকায় সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

বিক্রমজিৎ বর্ধন বাংলা টিভির শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। তিনি শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাড়াউড়া চা-বাগানের বাসিন্দা।

এদিকে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সিলেটের কানাইঘাট পৌরসভার নন্দিরাই পশ্চিম জামে মসজিদের উত্তরে বোরহান উদ্দিন সড়কে দুর্ঘটনায় রিয়াজ আহমদ (২৩) নামে মোটরসাইকেল আরোহীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুজন। নিহত রিয়াজ আহমদ উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদল ছোটফৌদ গ্রামের জালাল উদ্দিনের ছেলে। তিনি একটি কোম্পানিতে এসআর হিসেবে কাজ করতেন।

এছাড়াও শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের গ্যাস পাম্প এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালবাহী কাভার্ডভ্যানকে পেছন থেকে অপর আরেকটি ডিমবাহী কাভার্ডভ্যান ধাক্কা দিলে হেলপার মো. মিরাজ মিয়ার (২৫) মৃত্যু হয়। এসময় চালক সালাউদ্দিন গুরুতর আহত হন।

নিহত মিরাজ মিয়ার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাসিন্দা ও আহত ড্রাইভার মো. সালাউদ্দিন কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম এলাকার বাসিন্দা।

এর আগে ৫ নভেম্বর রাত ১০টায় ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন ১০ দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়া সিলেটের জকিগঞ্জের এক ছাত্রলীগ নেতার। সায়ান হাবীব জুয়েল (২৪) নামের ওই যুবক জকিদঞ্জের বীরশ্রী ইউনিয়নের মৃত আব্দুর রহিম মেম্বারের ছেলে। তিনি কলেজছাত্র ছিলেন। গত ২৭ অক্টোবর শেওলা-জকিগঞ্জ সড়কের ঈদগাহ বাজারে ব্যাটারিচালিত রিকশার সাথে জুয়েলের মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ হয়। এতে তিনি গুরুতর আহত হলে সিলেটের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার একটি  হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ৫ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে ঢাকার ওই হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন জুয়েল।

এর দুদিন আগে দুই দিনে সিলেটে ঘটে তিনটি সড়ক দুর্ঘটনা। এতে প্রাণ হারান দুজন। এর মধ্যে জকিগঞ্জে দুটি অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত যুবকের কিছুদিন আগে আমেরিকা প্রবাসী কনের সঙ্গে আক্দ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। নববধূকে ঘরে তোলার আগেই সড়কে ঝরে যায়  তাঁর প্রাণ।

এর আগের সপ্তাহে মাত্র ২২ ঘণ্টায় সিলেটে ৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন চারজন। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে মোটরসাইকেল আরোহী দুই তরুণের।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- সিলেট বিভাগে অক্টোবর মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত শিশু ও নারীসহ অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে সড়কে।

সিলেটে একের পর এক সড়কে প্রাণ ঝরলেও আইনের যথাযথ প্রয়োজন নেই বলে দাবি করছেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা বলছেন- নিরাপদ সড়ক গঠনে ২০১৮ সালে প্রণিত আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথমে সরকার, প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলের সদিচ্ছা প্রয়োজন। তা না হলে সড়কে লাশের দীর্ঘ মিছিল ঠেকানো সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে ভোক্তভুগী ও বিশ্লেষকরা বলছেন- বেপরোয়া গতি, সড়কে বিপজ্জনক বাঁক, রোড মার্কিংয়ের অভাব, ফিডার রোড (পার্শ্ব রাস্তা) এবং অটোরিকশার দাপট সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ার মূল কারণ। এ পাঁচটির পাশাপাশি ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, গতিসীমা অনুসরণ না করা, মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী বা মালামাল বহন করা, রোড সাইন, মার্কিং ও ট্রাফিক সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা না থাকা বা ধারণা থাকলেও তা মেনে না চলা, ওভারটেক, সামনের গাড়ির সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানো, চালকের পরিবর্তে হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে গাড়ি চালানো, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না নিয়ে অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় একটানা গাড়ি চালানো, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো, শিক্ষার স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত ট্রেনিং এবং অনভিজ্ঞতাও দুর্ঘটনার কারণ।

তবে এসব ‘অপরাধ’ ঠেকাতে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতাও লক্ষণীয় বলে দাবি করছে সচেতন মহল। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হওয়া প্রয়োজন মনে করছেন সচেতন সিলেটবাসী।

‘নিসচা’র সিলেট মহানগর কমিটির সভাপতি এম ইকবাল হোসেন  বলেন- ‘ নিরাপদ সড়ক গঠনে ২০১৮ সালে প্রণিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথমে প্রয়োজন সরকার, প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলের সদিচ্ছা। তারপর সড়কে চলাচলে চালক, মালিক, যাত্রী, পথচারী সবাইকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

তিনি বলেন- ২০১৮ সালের আইনে অনেক ফাঁকও রয়েছে। সেগুলো চিহ্নিত করে নীতিমালার দ্রুত সংযোজন প্রয়োজন। যেমন- আইনে রাস্তায় যানবাহনের ধরনভেদে কোন গাড়ির কত গতি হবে সে সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। মোটরসাইকেল চালকদের প্রতি হেলমেট মেইনটেইন ও পরিধানের কোনো নির্দেশনা না থাকায় শুধুমাত্র আইনের হাত থেকে বাঁচতে নি¤œমানের হেলমেট ব্যবহারিত হয়। শুধু চালককে সিটবেল্ট ব্যবহারে নির্দেশনা থাকায় যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেন। তাছাড়া ডোপ টেস্টের সঠিক ব্যবহার ও মনিটরিং না থাকায় এখনও অনেক চালক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালনা করেন।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও দুর্ঘটনা রোধে করণীয় বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশ সিলেট রিজিওনের এসপি (পুলিশ সুপার) মো. শহীদ উল্লাহ বলেন, উঠতি বয়েসি ছেলেরা রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়। তাদের থাকে না লাইসেন্স। সঙ্গে থাকে না হেলমেট। রাস্তায় গতির প্রতিযোগিতা করে। ফলে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকেই মারা যান এমন দুর্ঘটনায়। রাস্তায় এমন বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো দেখলে আমরা চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই।

তিনি আরও বলেন, মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ত্রি-হুইলার চলাচলের অনুমতি নেই। তবুও এসব গাড়ি মহাড়সকে চলে। এদের যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই। পুলিশ দেখলেই গাড়ির গতি বেপরোয়াভাবে বাড়িয়ে পালিয়ে যেতে চায়। লাইসেন্সবিহীন এসব অদক্ষ ড্রাইভারের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। তবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দেই। আবার এসব অদক্ষ ড্রাইভারদের কারণে কারো মৃত্যু হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করি।

হাইওয়ের এই পুলিশ সুপার বলেন, ট্রাফিক নিয়ম অনুযায়ী মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু সেটি অনেকেই মানেন না। বিশেষ করে কমবয়েসি মোটরসাইকেল চালকরা। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আছি, আরও কঠোর হবো।

এসপি শহিদুল্লাহ আরও বলেন- অনেক সময় পথচারীদের ভুলের কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। যে যেভাবে পারছে সড়ক পার হচ্ছে। আমরা সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছি। বিভিন্ন সময় সভা-সেমিনার করছি। চালক ও হেলপারদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তবে সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে এবং কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *