বরাদ্দ আসে, বরাদ্দ শেষ হয়। কথার ফুলঝুরি ছুটে, উন্নয়নের গল্পে বিভোর হয় মানুষ। কিন্তু কর্তা ব্যক্তিদের মুখের কথার সাথে বাস্তব পরিস্থিতির যে কতো ফারাক, তা স্পষ্ট করে দিতে পারে মাত্র এক ঘন্টার টানা বৃষ্টি! যে বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় প্রায় অর্ধেক সিলেট নগরী, সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার, চরম ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। অথচ গত প্রায় এক যুগে সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ এসেছে। জলের সমস্যা নিরসনে বরাদ্দকৃত সেইসব টাকা জলেই গেল কিনা, নগরবাসীর মধ্যে এখন এমনটাই প্রশ্ন।
আবহাওয়া অফিস জানায়, গত ৭ জুলাই থেকে তীব্র খরতাপে পুড়ছে সিলেট। প্রচণ্ড গরমে মানুষ যখন অতিষ্ঠ, তখন স্বস্তি নিয়ে শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে আসে ভারী বৃষ্টি। টানা প্রায় এক ঘন্টার সেই বৃষ্টিতে নগরীর বেশকিছু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। জিন্দাবাজার, বারুতখানা, হাওয়াপাড়া, উপশহর, যতরপুর, ছড়ারপাড়, ভাতালিয়া, জল্লারপাড়, তালতলা, চৌহাট্টা, সুবিদবাজার, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদ, শিবগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুপানি জমে। নালা-নর্দমা উপচে সড়কে পানি জমে, পরে সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ে মানুষের বাসা-বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। এতে হাজার হাজার নগরবাসী মধ্যরাতে দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন।
নগরবাসী বলছেন, সিলেট নগরীতে যাতে জলাবদ্ধতা না হয়, সেজন্য গত প্রায় এক যুগে হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ এসেছে। ছড়া-খাল উদ্ধার, খনন ও প্রশস্তকরণ, ড্রেন নির্মাণসহ জলাবদ্ধতা নিরসনের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজে এসব টাকা ব্যয় করার কথা। কিন্তু এক ঘন্টার বৃষ্টিতেই যখন নগরীতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, তখন বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি হয়ে পড়ে।
যেমনটি বলছিলেন নগরীর শিবগঞ্জের বাসিন্দা কাজী শওকত, ‘দেখুন, জলাবদ্ধতা নিরসনে মেয়র কামরান সাহেবের আমল থেকে শুরু করে আরিফ সাহেবের যুগেও আমরা শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ আসতে দেখছি। কিন্তু সেই বরাদ্দ আসলে যাচ্ছে কোথায়? যদি সঠিকভাবে কাজ হতো, তাহলে তো এতোদিনে জলাবদ্ধতামুক্ত নগরী আমরা দেখতে পেতাম। কিন্তু এখন এক ঘন্টা টানা বৃষ্টি হলে নগরী তলিয়ে যায়!’
উপশহরের বাসিন্দা মো. ওবায়দুল্লাহ সিলেটভিউকে বলেন, ‘সবক্ষেত্রে জবাবদিহিতা জরুরি। বরাদ্দ এলো, সেই বরাদ্দ কোথায়, কোন খাতে, কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কাজের মান কতোটুকু এসবে স্বচ্ছতা থাকা দরকার। না হলে বরাদ্দ আসবে, সেই বরাদ্দ জলে যাবে নাকি কারো পকেটে যাবে, এ নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস, প্রশ্ন থাকবেই।’
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীতে ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও (খাল) আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। নালা-নর্দমায় প্রায় সাড়ে ৬শ’ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে।
সিসিকের প্রকৌশল শাখা সূত্র জানায়, বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মেয়র থাকাবস্থায় ২০০৯ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে ছড়া-খাল খনন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১২ সালে ২৭টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় করা হয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে সিসিক মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ওই বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ অবধি ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।
২০১৯ সালে ‘সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ আসে ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; যা বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।
তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ এই প্রকল্পটির কাজ এখনও শেষ হয়নি এবং চলমান আছে বলে জানিয়েছেন সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান।
তিনি সিলেটভিউকে বলেন, ‘ওই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতিতে ব্যয় হবে। তবে আমরা এখন অবধি প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো পেয়েছি। সে টাকায় কিছু কাজ হয়েছে, কিছু কাজ চলমান আছে।’
এবার এক ঘন্টার বৃষ্টিতেই নগরীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, এমন প্রশ্ন ছিল নূর আজিজুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, ‘গত মাসে সিলেটে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, সেই বন্যার পানিতে পলিমাটি ভেসে এসেছে। বন্যার পানি নামলেও পলিমাটির আস্তরণ পড়েছে ড্রেনে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে যততত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার বিষয়টি। সবমিলিয়ে এবার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে আগের চেয়ে জলাবদ্ধতা অনেক কমে এসেছে।’
সিসিকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ড্রেনেজ ব্যবস্থা পরিষ্কারে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। দ্রুত ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হবে। তবে ড্রেনের মাধ্যমে পানি যাতে দ্রুত নেমে যায়, সেজন্য নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। ময়লা-আবর্জনা যেখানে-সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, ড্রেনে কিছুতেই ময়লা-আবর্জনা ফেলা যাবে না।’
নূর আজিজুর রহমান আরও বলেন, ‘ড্রেনের ভেতরে যাতে ময়লা-আবর্জনা না জমে, সেজন্য আমরা ড্রেনের মুখে নেটের (জাল) ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, সেইসব নেট স্থানীয়রা খুলে ফেলেন। নেট থাকলে পানি চলে যেতো, ময়লা-আবর্জনা আটকে যেতো।’
এ বিষয়ে কথা বলতে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি।
শেয়ার করুন