বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারের টাকা রিচার্জ করতে গিয়ে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন লাখ লাখ গ্রাহক। আগে রিচার্জ করতে গ্রাহককে মিটারে ২০টি ডিজিট প্রবেশ করাতে হতো। এখন করাতে হচ্ছে ২০০ থেকে ২৪০টি ডিজিট। এতগুলো ডিজিট একসঙ্গে প্রবেশ করাতে গিয়ে অনেকেই ভুল করছেন। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বারবার ভুল করার ফলে মিটার লক হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে গ্রাহকদের। অভিযোগকেন্দ্রে জানিয়েও সহসাই সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার হচ্ছে অফলাইন এবং অনলাইন। মূলত অফলাইন গ্রাহককে এ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গত ১২ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম গড়ে ইউনিট প্রতি ৩৬ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের ট্যারিফ চেঞ্জ হওয়ার পর থেকে এ টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন- এ ৩ পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও এ সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তখন গ্রাহকে ১০০টি ডিজিট প্রবেশ করিয়ে রিচার্জ করতে হয়েছে। এখন একজন গ্রাহককে একবারই ২০০-এর অধিক ডিজিট প্রবেশ করিয়ে ব্যালেন্স রিচার্জ করতে হবে। যাদের সমস্যা হচ্ছে বা মিটার লক হয়ে যাচ্ছে সেগুলো সমাধান করে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো সমাধান আপাতত নেই। তবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। বলছেন কিছুটা বিলম্ব হলেও ফলাফল আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে গত বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের মোট গ্রাহকসংখ্যা ৪ কোটি ৩১ লাখ। এর মধ্যে বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার আছে ৫২ লাখ ২ হাজার ৩২২টি। সারাদেশে পল্লী বিদ্যুতের ৮০টি সমিতির আওতায় রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি গ্রাহক। প্রিপেইড মিটারধারী ১৩ লাখ ১০ হাজার ৫৬৪, এর মধ্যে ১০ লাখের অধিক হচ্ছে অফলাইন মিটারধারী। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ১৫ লাখ ৬৬ হাজার ২৯১, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ৬ লাখ ৪২ হাজার ৪৬৯, ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) ৬ লাখ ১৪ হাজার ২০৫, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. (ওজোপাডিকো) ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯২৩ ও নর্দান ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) ৫ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করেছে। এ ৫ বিতরণ কোম্পানিরও কয়েক লাখ অফলাইন প্রিপেইড মিটার গ্রাহক রয়েছে।
জানা গেছে, সিলেট বিভাগে প্রায় ৫ লাখ বিদ্যুতের গ্রাহক থাকলেও প্রিপেইড মিটারের আওতায় আছেন আড়াই লাখের মতো। এরমধ্যে সিলেট নগরীর প্রিপেইড মিটারের গ্রাহক রয়েছেন ১ লক্ষাধিক।
গ্রাহকরা বলছেন, প্রিপেইড মিটার স্থাপনের শুরুতে টাকা রিচার্জ নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও কর্তৃপক্ষ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সমাধান করতে সক্ষম হন। সম্প্রতি বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর পর প্রিপেইড মিটারে ব্যলেন্স রিচার্জ করতে গিয়ে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মিটারে টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পর রিচার্জ করতে না পারায় অনেকে দিনের পর দিন অন্ধকারে থাকছেন।
ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে যোগাযোগ করা হলেও তারা সুনির্দিষ্ট কোনো সমাধান দিতে পারেনি। টেকনিক্যাল ইস্যুতে এমনটা হয়ে থাকে বলে জানানো হয়। অগত্যা ২০০ থেকে ২৪০ ডিজিট চেপেই বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে ২২০-৪০ ডিজিটের প্রিপেইড মিটারের টোকেন নাম্বার। এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ ২২০ ডিজিটের নাম্বার রিচার্জ করতে গিয়ে ভোগান্তিতে দিশেহারা সিলেটের কয়েক লক্ষাধিক গ্রাহক। বিদ্যুতের বর্ধিত দর কার্যকর হওয়ার পর যারা রিচার্জ করতে যাচ্ছেন তারা এ ভোগান্তিতে পড়ছেন।
নগরীর দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মিটার নাম্বার দিয়ে রিচার্জ করার পর বেশ কয়েক ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে টোকেন নাম্বার আসতে। মিটারের ২২০ ডিজিট নাম্বার কিছুক্ষেত্রে ওয়াটসআপ ও ম্যাসেজে দেয়া গেলেও অনেককে কাগজের মধ্যে লিখে দিতে আমাদেরও সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় ডিজিট লিখতে ভুল হয়ে যায়। আবার সেই ডিজিট মিটারে একাধিকবার প্রবেশ করাতে গ্রাহকদের ভুল হচ্ছে। ফলে গ্রাহকরা মনে করছে দোকানীরা নাম্বার লিখে দিতে ভুল করছে। অনেক সময় আমাদের সাথে গ্রাহকদের বাক বিতণ্ডা পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে।
নগরীর শিবগঞ্জ এলাকার গৃহিণী নাসরিন বলেন, ২২০ ডিজিটের নাম্বার মিটারে ডায়াল করেছিলাম কিন্তু ঘরে বিদ্যুৎ আসেনি, ভেবেছিলাম এডভান্স আর মিটার চার্জ বাবদ টাকা কেটে ফেলেছে, তাই দ্বিতীয়বার রিচার্জ করতে কয়েকবার ডায়াল করতে গেলে মিটার লক হয়ে যায়। শেষমেষ পিডিবির মানুষ এনে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে মিটার রিচার্জ করিয়েছি।
সোবহানীঘাট এলাকার বাসিন্দা দিদার বলেন, ২২০ ডিজিটের নাম্বার মিটারে প্রবেশ করাতে কয়েকবার ভুল হচ্ছে ফলে মিটার লক হয়ে যাচ্ছে এতে করে লক খোলাতে আমাদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে। শঙ্কায় থাকি কখন আবার মিটারের টাকা শেষ হয়ে যায়। পুনরায় রিচার্জ করতে গেলে মিটার লক হয়ে যাবে। এমনিতে ফ্যামিলি চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে সেখানে আবার মিটার লকের অতিরিক্ত খরচ মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাধারণত বিদ্যুৎ অফিস থেকে দেওয়া ২০ টি ডিজিট বাটন দিয়ে প্রবেশ করাতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার পর রিচার্জ এর ক্ষেত্রে প্রবেশ করাতে হচ্ছে ২২০টি ডিজিট। তাতে দুইবারের বেশি ভুল হলে লক হয়ে যায় মিটার তখন জরিমানা দিয়ে খুলতে হয় লক।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগীয় অফিসের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল কাদির বলেন, বিল বাড়ার সাথে টোকেন বাড়ছে। এটা কারিগরি সিস্টেম। গ্রাহকরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সত্য তবে চাইলেই এ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই। এ সমস্যা সারাদেশেই হচ্ছে।
তিনি বলেন, সিলেট বিভাগে প্রায় ৫ লাখ বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছেন। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রিপেইড মিটারের আওতায়। প্রায় আড়াই লাখ গ্রাহকের ভোগান্তি বিবেচনায় আমরা বিপিডিবি এর বোর্ড মিটিংয়ে টোকেন কমানোর উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ টোকেন কমানোর জন্যে কাজ করছেন।
বিউবো সিলেট বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামছ-ই-আরেফিন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, মিটারের ডিজিট নিয়ে অভিযোগ আসছেনা এমন নয়। কিন্তু এ নিয়ে আমাদেরও কিছু করার নেই। আমার বিবিবি-২ এর আওতায় ৫২ হাজারের বেশী প্রিপেইড মিটারের গ্রাহক রয়েছেন। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে ডিজিট বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ তৈরী হয়নি। রিচার্জ করতে গিয়ে লক হলে দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে।
শেয়ার করুন