৫১ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি মাধবপুরের মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর

হবিগঞ্জ

 ৪এপ্রিল ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বৈঠক হয়েছিল।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঊর্ধ্বতন ২৭ সেনাকর্মকর্তার উপস্থিতিতে এ বৈঠকেই দেশকে স্বাধীন করার শপথ এবং যুদ্ধের রণকৌশল গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেডে। বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানী, তৎকালীন মেজর সিআর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, কর্নেল এমএ রব, রব্বানী, ক্যাপ্টেন নাসিম, আব্দুল মতিন, মেজর খালেদ মোশাররফ, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, ভারতের ব্রিগেডিয়ার শুভ্র মানিয়ম, এমপিএ মৌলানা আসাদ আলী, লে. সৈয়দ ইব্রাহীম, মেজর কেএম শফিউল্লাহ প্রমুখ।

১নং সেক্টরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান পরে মেজর রফিকুল ইসলাম। ২নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন প্রথমে খালেদ মোশাররফ পরে মেজর হায়দার।৩নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর শফিউল্লাহ পরে মেজর নুরুজ্জামান।৪নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর সি আর দত্ত। ৫নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। ৬ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন উইং কমান্ডার বাশার। ৭ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজী নূরুজ্জামান। ৮ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর ওসমান চৌধুরী মেজর এমএ মনছুর। ৯নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মেজর আব্দুল জলিল এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন এমএ মঞ্জুর। ১০ নং সেক্টর নৌ-বাহিনীর সৈনিকদের নিয়ে গঠন করা হয়।

এছাড়া ১১ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু তাহের ও পরে ফ্লাইট লে. এম হামিদুল্লাহ। আর জিয়াউর রহমানের নাম অনুসারে ‘জেড ফোর্স’ জিয়াউর রহমানের দায়িত্বে, মেজর শফিউল্লাহর নাম অনুসারে ‘এস ফোর্স’ মেজর সফিউল্লাহর দায়িত্বে এবং খালেদ মোশাররফের নাম অনুসারে অপর ব্রিগেড ‘কে ফোর্সে’র দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফের উপর। ৩নং সেক্টর কমান্ডার মেজর কে.এম শফিউল্লাহ্ তার হেড কোয়ার্টার স্থাপন করেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। সড়ক ও রেলপথে বৃহত্তর সিলেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এখান থেকে মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করা ছাড়াও তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে উঠে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ কয়েকটি সেক্টরের কমান্ডাররা বিভিন্ন সময়ে তেলিয়াপাড়া সফর করেন। ম্যানেজার বাংলোসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সেনানায়কদের পদচারণয় মুখরিত।

১৯৭১ সালের ২১জুনের পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের কারণে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থাপিত সেক্টর হেড কোয়ার্টার তুলে নেয়া হয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিজড়িত তেলিয়াপাড়া চা বাগান স্মৃতিসৌধ এলাকা এখন আকর্ষণীয় পিকনিক স্পটে পরিণত হয়েছে। অত্যন্ত সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন বুলেট আকৃতির স্মৃতিসৌধ, ম্যানেজার বাংলো ও চা বাগানের অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে পিকনিক স্পট। প্রতিবছর শীত মৌসুম আসার সাথে সাথে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য পিপাসুরা পিকনিক করতে ছুটে আসেন তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক কিংবা তেলিয়াপাড়া রেলস্টেশন হতে প্রায় দুই কিলোমিটার অভ্যন্তরে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা স্থানে অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলো। বাংলোর পাশে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে বুলেট আকৃতির স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ম্যানেজার বাংলোর যে ভবনটিতে সেনানায়ক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের বৈঠক হতো সেই বাংলোটি আজও স্মৃতি ধারণ করে আছে।

এদিকে পিকনিকে আসা দর্শনার্থীরা স্মৃতি সৌধ এবং সেই বাংলোটির কক্ষগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে তৃপ্ত বোধ করেন। পিকনিকে আসা লোকজন স্মৃতিসৌধের পাশে বসে, বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে কিংবা ফুল বাগিচায় ছবি তুলতে কখনো ভুল করেন না। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানটিকে দর্শনার্থীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পাকা সড়ক, রেস্ট হাউজ নির্মাণসহ সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে অনেক দর্শনার্থী দাবি জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন সাবেক সেনা প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। দক্ষিণ দিকে লাগানো ফলকটি  শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত। সেখানে স্মৃতিফলকে রয়েছে রাজনৈতিক নেতা,সাবেক সেনা,সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা। চা-বাগানের সবুজের বেষ্টনীতে স্মৃতিসৌধ ছাড়াও আছে একটি প্রাকৃতিক হৃদ। লাল শাপলা ফোটা এই হৃদ বর্ষাকালে অপরূপ হয়ে ওঠে। স্মৃতিসৌধ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই ঐতিহাসিক বাংলোটি।

স্থানীয় জনগণ বহুকাল ধরেই  মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাৎপর্যময় বাংলোটিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির দাবী  করে আসছে, তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি আজও ভবিষ্যতে কখনো বাস্তবায়ন হবে কিনা সে ব্যাপারেও রয়েছে ব্যাপক সন্দেহ।

সাবেক ইউ/পি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আব্দুল আলী শাহ বলেন, ”তেলিয়াপাড়া বাংলোটি আমাদের গর্বের, বহু ত্যাগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী। এটি এখনও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসেনি। এখনও সেটি তেলিয়াপাড়া চাবাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলো হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।’ বাংলোটির নিয়ন্ত্রণ সরকারের কাছে নিয়ে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি ”। মাধবপুর উপজেলা মুক্তি সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযুদ্ধা আব্দুল মালেক মধু বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এখানে এসে যাদুঘর হবে বলে আশ্বাস দিয়ে যায় কিন্তু এখনো কিছু হচ্ছে না।

স্মৃতিসৌধ এলাকায় অরক্ষিত থাকায় বাইরে থেকে লোকজন এসে এখানে মাদক সেবন করে, যা খুবই দুঃখজনক। আমাদের দাবি এখানে যাদুঘর নির্মাণ করে মুক্তিযুদ্ধের এখানকার স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা হোক। প্রতি বছর সরকারী ভাবে ৪ঠা এপ্রিল বৃহৎ পরিসরে যেন পালন করা হয়। তিনি আরও জানান পবিত্র রমজানের কারণে এবছর ৪ঠা এপ্রিলে কোন সভা সমাবেশ করা হবে না। সকালে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *