সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে ভিসা বন্ধ : আমেরিকার ঘোষণায় তোলপাড়

জাতীয়

স্বাগত জানালো বিএনপি-জাপা,পাত্তা দিচ্ছেনা আ’লীগ
৩ সপ্তাহ আগেই সিদ্ধান্তের কথা জানায় আমেরিকা

বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এর আওতায় পড়বেন বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার-সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারবিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা। বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের এই ঘোষণার পর রীতিমতো তোলপাড় চলছে।
সরকারের ভেতরে যেমন মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তেমনি দেশ ও বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী মানুষের মাঝেও বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক তথা সর্বমহলে বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সাথে বৈঠকও করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বৈঠক শেষে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। তবে আওয়ামীলীগ জানিয়েছে তারা এটিকে পাত্তা দিচ্ছেনা। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা করা ভিসানীতি যথেচ্ছভাবে প্রয়োগের পরিবর্তে বস্তুনিষ্ঠতার সাথে অনুসরণ করা হবে- এমনটাই আশা করে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন প্রথমে টুইট করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। পরে এ বিষয়ে তার বিস্তারিত বিবৃতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে: ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনেও বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি চালুর বিষয়টি তুলে ধরেন


সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, তারা কোনো নিষেধাজ্ঞা দেননি। তবে এসব ধারার অধীনে আইনসম্মতভাবে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত আছেন। বাংলাদেশের জনগণকে এই বার্তা দিতে চেয়েছেন যে তারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে এবং এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ম্যাথু মিলার বলেন, বাংলাদেশের যেকোনো ব্যক্তিকে এই বার্তা দিতে চেয়েছি যে আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি।

প্রশ্নোত্তরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে এটা একটি বার্তা যে আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করি এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্তকারী ব্যক্তিকে জবাবদিহির আওতায় আনার সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। নির্বাচনে অনিয়ম প্রমাণিত হলে এই ভিসা নীতির আওতায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন ম্যাথু মিলার।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির আদেশদাতা এবং আদেশ বাস্তবায়নকারী উভয়ের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র-ঘোষিত নতুন ভিসা নীতি নিয়ে তিনি বুধবার রাতে কথা বলেছেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের টক শো তৃতীয় মাত্রায়। জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় সরাসরি সম্প্রচারিত এই অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড লু বুধবার রাতে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, তাঁর দেশের সরকার কারও বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। নতুন ভিসা নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য জড়িত ব্যক্তিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।

তিনি বলেন, চারটি ক্ষেত্রের কোনো একটিতে জড়িত থাকলে এই নীতির আওতায় তারা যে কারও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারেন। ক্ষেত্রগুলো হলো ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, ভোট কারচুপি, বাক্স্বাধীনতা বা সমাবেশের স্বাধীনতায় বাধাদান এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে সহিংসতা সৃষ্টি।

অপর একটি প্রশ্নের জবাবে ডোনাল্ড লু বলেন, যারা আদেশ মেনে সহিংসতা বা ভোটারদের ভয় দেখাবেন বা ভোট কারচুপি করবেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। একই সঙ্গে যারা আদেশ দেবেন, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে এই নতুন নীতি সম্পর্কে আগাম জানিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত ছিলাম। তাই আমাদের ৩ মে জানিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত এবং সে বিষয়ে আজকের ঘোষণা কোনোভাবেই বাংলাদেশ সরকারের ১৪ মে নেওয়া সিদ্ধান্তের পাল্টা পদক্ষেপ হওয়ার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রতিশোধের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়নি, নেবেও না।

ডোনাল্ড লু বলেন, আগামী বছর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে বাংলাদেশের জন্য কঠিন সময় হতে পারে। আবার এই নির্বাচন সত্যিই একটি আনন্দময় যুগের সূচনা করতে পারে।মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বৈঠক : সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না, এমন নীতি ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। দুপুরে রাজধানীর গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় পিটার হাসের সঙ্গে তিন দলের নেতাদের প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বৈঠকটি হয়। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় বৈঠকটি শুরু হয়ে শেষ হয় বেলা পৌনে ২টায়।

বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন দলের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও কেন্দ্রীয় নেতা মো. এ আরাফাত। বিএনপির পক্ষে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ। আর জাতীয় পার্টির পক্ষে ছিলেন মহাসচিব মুজিবুল হক (চুন্নু) ও প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল। বৈঠক শেষে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, তারই প্রতিফলন মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা (বস্তুত নতুন ভিসা নীতি)। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে এটি একটা বড় পদক্ষেপ। এ পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই।
আর জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন ভিসা নীতির উদ্দেশ্য বোঝা গেছে, তারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং নির্বাচনটা যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়। এ ব্যাপারে আমাদের দলও একমত।

আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, আমরা বলেছি, এটা নিয়ে আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এটাকে আমরা পাত্তা দিচ্ছি না।

বৈঠক শেষে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাদের ফেসবুক পেজে পিটার হাসের বার্তা প্রচার করে। সেখানে তিনি বলেন, আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এমন ব্যক্তিদের ভিসা সীমিত করার এই নতুন ভিসা নীতি সবার জন্য প্রযোজ্য।পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাত : বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতেই যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৃহস্পতিবার বিকেলে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ মন্তব্য করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই সাক্ষাৎ শেষে পিটার হাস বলেন, এটি পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ ছিল এবং আমাদের নিয়মিত বৈঠকের অংশ। বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তা নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি এবং গতকাল আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) বিবৃতিতে যা দেখেছেন, তা বাংলাদেশের জনগণ, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীসহ সবার জন্য একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *