সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ছাত্রলীগের কমিটি নেই এক দশকের বেশি সময় ধরে। কমিটি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা। কমিটি না থাকায় নানা গ্রুপ, উপগ্রপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখতে প্রায়ই সংঘাতে জড়াচ্ছে বিবদমান গ্রুপগুলোর নেতাকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
সবশেষ গত সোমবার হলের ক্যান্টিন থেকে বের হওয়ার সময় শরীরে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে শাবি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলের এক নেতার কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, সোমবার দুপুরের দিকে ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হুদা শুভ শাহপরান হলের ক্যান্টিন থেকে বের হচ্ছিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক খলিলুর রহমানের অনুসারী মো. শিপন হাসানের সঙ্গে নাজমুলের ধাক্কা লাগে। এ নিয়ে দুই পক্ষের বিবাদের সূত্রপাত ঘটে।
এর আগে গত ৩১ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে শাবি ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের তিন কর্মী আহত হন। এক ছাত্রীকে নিয়ে দুই ছাত্রের তর্কের জেরে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত বলে জানা গেছে।
শাবি ছাত্রলীগে এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়শই। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সংঘর্ষ ও বিশৃঙ্খলায় জড়াচ্ছেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। এ জন্য দীর্ঘ কমিটিহীনতাকে দায়ী করা হচ্ছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটি হয়েছিল ১০ বছর আগে। ২০১৩ সালের ৮ মে এক বছর মেয়াদি শাবি ছাত্রলীগের ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার দুই বছর পর ২০১৬ সালের ৮ মে এই কমিটিকে ১৫১ সদস্যে পূর্ণাঙ্গ করা হয়। এরপর ২০২১ সালের ১৭ জুন এই কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর থেকে সেখানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। কমিটি না থাকায় শাবি ছাত্রলীগে অস্থিরতা ও হতাশা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারাও।
শাবি ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের নেতা সজিবুর রহমান বলেন, ‘সংগঠনের জন্য আমি এতকিছু করলাম, কিন্তু দেয়ার মতো কোনো পরিচয় নেই। আমাদের তো ছাত্রত্বও শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্যাম্পাস থেকে বের হলে তো কোনো পরিচয় নেই। দলের শৃঙ্খলার জন্যও কমিটি প্রয়োজন।’
কমিটি না থাকায় নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না জানিয়ে শাবি ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপের নেতা মামুন শাহ বলেন, কারো কোনো সাংগঠনিক পরিচয় নেই। এতে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নতুন নেতৃত্বও আসে না। হতাশ হয়ে অনেকে ক্যাম্পাসও ছেড়ে দিচ্ছে।
জানা যায়, সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকাকালীন শাবি ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সে সময় পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্তও নেয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কমিটি পরিবর্তন হয়েছে চার দফা। তবে শাবি ছাত্রলীগের আর কমিটি হয়নি।
দীর্ঘদিন কমিটিহীন থাকার কারণে শাবি ছাত্রলীগে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে আছে সংগঠনটি। শাবি ছাত্রলীগের প্রধান সাতটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন হাফিজ আল আসাদ, খলিলুর রহমান, সজিবুর রহমান, মামুন শাহ, মেহেদী হাসান স্বাধীন, সুমন সুরকার ও তারেক হালিমী।
ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কমিটি না থাকায় ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশীরা নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে আলাদা আলাদা গ্রুপ সৃষ্টি করেছেন। পদপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ক্যাম্পাসে গ্রুপ-উপগ্রুপের সংখ্যাও বাড়ছে।
শাবি ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের নেতা সজিবুর রহমান বলেন, নিয়মিত কমিটি হলে নেতৃত্ব বেরিয়ে আসত। একটা সাংগঠনিক কাঠামো ও শৃঙ্খলা থাকত। কমিটি না থাকায় কর্মী ধরে রাখার জন্যও বিভিন্ন বলয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
ক্যাম্পাসে ছয়টি গ্রুপ আছে জানিয়ে আরেকটি গ্রুপের নেতা খলিলুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগ অনেক বড় সংগঠন। তাই আলাদা বলয় হতেই পারে। তবে কমিটি না থাকার কারণে গ্রুপ বেড়েছে। কমিটি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের চেইন অব কমান্ড নেই।
নতুন কমিটিতে পদ বাগিয়ে নিতে ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া শাবি ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপগুলো। এতে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৬ মাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে মারামারি ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের অন্তত ১৬টি ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৬ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মুজতবা আলী হলের কক্ষ থেকে দুই আবাসিক শিক্ষার্থীকে গালিগালাজ ও মারধর করে বের করে দেন ছাত্রলীগ নেতা আজিজুল ইসলাম সীমান্ত ও তার অনুসারীরা।
এ ঘটনায় ৩১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকায় শাহপরান হলের আবাসিক ছাত্র আজিজুল ইসলাম সীমান্তকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
গত ১৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ছাত্রলীগের নেতা রিশাদ ঠাকুর তার কক্ষে ডেকে এনে সংগঠনের কর্মী নূর মোহাম্মদ বায়েজিদকে বেধড়ক মারধর করেন। এ ঘটনায় ২০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা রিশাদ ঠাকুরকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আজীবনের জন্য অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে।
এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সানজিদ চৌধুরী এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে গণিত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. দেলোয়ার হোসেনকে মারধর করে বের করে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া গত সাড়ে সাত মাসে হলের আসন দখল ও আধিপত্য বজায় রাখা নিয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন দলের মধ্যে বেশ কয়েকটি পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নির্যাতন ও বারবার সংঘাতে জড়ানো প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. কামরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘কোনো অভিযোগ পেলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই। কে কোন দলের তা আমরা বিবেচনায় নিই না। তা ছাড়া অন্যান্য ক্যাম্পাস থেকে আমাদের ক্যাম্পাস অনেক শান্ত রয়েছে।’
শেয়ার করুন