তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘণ্টা বেজে গেছে। আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি হবে ভোট। আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে লাখার লক্ষ্যে জোরালোভাবে ভোট প্রস্তুতিও শুরু করেছে। এখন জল্পনা-কল্পনা কেবল কে নৌকা পাবেন, কে বাদ পড়বেন- তা নিয়ে। বর্তমান সংসদ সদস্য ও নতুনদের পাশাপাশি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঞ্চিত নেতারাও এবার ভোটযুদ্ধে নৌকা প্রাপ্তির অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে একাদশে মনোনয়ন বঞ্চিত কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ইতোমধ্যে সবুজ সংকেত দিয়েছেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতবার দলটির কয়েকজন কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্য মনোনয়ন বঞ্চিত হন। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণবিষয়ক সাবেকমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীরবিক্রম, তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং বিএম মোজাম্মেল হক।
দশম জাতীয় সংসদে জাহাঙ্গীর কবির নানক (ঢাকা-১৩), আব্দুর রহমান (ফরিদপুর-১), বিএম মোজাম্মেল হক (শরীয়তপুর-১), আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম (মাদারীপুর-৩) ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (চাঁদপুর-২) আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানক, মায়া, রহমান ও নাছিমের মনোনয়ন থেকে বাদ পরার ঘটনায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কৌতুহলের সৃষ্টি হয়। কারণ, সেসময় তাদের তুলনায় দলের রাজনীতিতে তুলনামূলক কম পরিচিতদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হন ৫৬ জন সংসদ সদস্য। তার আগে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনেও বাদ পড়েন ৪৯ জন সংসদ সদস্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে টানা চতুর্থবারের মতো দলের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য-জনপ্রিয় নেতাদের নৌকা তুলে দিচ্ছে দলটি। এ লক্ষ্যে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দফায় দফায় জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তাই যেসব প্রার্থীর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তারাই এবার মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে থাকছেন।
তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত হেভিওয়েট নেতাদের গণভবনে ডেকে নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই থেকে নেতারা ফের পুরোদমে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন। তারা নির্বাচন পরিচালনা কার্যক্রম মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করে লাইমলাইটে আসেন। সে ধারাবাবাহিকতার পরে মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের গুরুত্বপূর্ণ পদেও বসানো হয়। এর পর দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সময়ও ওইসব নেতারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আমাকে আসলে ঢাকা-১৩ তে মাননীয় নেত্রী (শেখ হাসিনা) মনোনয়ন দিয়েছিলেন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। সেই আসন থেকে পর পর দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত ছিলাম। মোহাম্মদপুর ছিল মুখ থুবড়ে পড়া একটি এলাকা। রাস্তাঘাট ছিল সব ভাঙাচুরা। আমি সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকাকে ঢাকার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য এলাকা বানিয়েছি। রাস্তা-ঘাট, অবকাঠামো থেকে শুরু করে সবধরনের উন্নয়ন হয়েছে আমার হাত ধরে।’
দ্বাদশের ভোটযুদ্ধে কি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে নানক বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দেননি। কিন্তু তারপরও আমি থেমে থাকেনি। আমি এলাকার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছি। মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি। স্বাভাবিকভাবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আসছে। আমি তো অবশ্যই এই এলাকা থেকে দলের মনোনয়ন চাইব।’
ঢাকা-১৩ আসনের জনগণের জন্য এবার আপনার প্রতিশ্রুতি কী থাকতে পারে? এর উত্তরে সাবেক এই স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকার এই দিকটার (ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর-আদাবর) মানুষের বিনোদনের জায়গা নাই। আমার খুব ইচ্ছা ছিল বসিলা নদীকে কেন্দ্র করে একটা ওয়াটার পার্ক করা। এখনও সেই ইচ্ছা আছে। এই এলাকাকে একটি শান্তিপূর্ণ এলাকা হিসেবে তৈরি করব। কারণ, এটি বিচিত্র এলাকা। এই এলাকায় বাঙালি মুসলমান-হিন্দু রয়েছেন। এখানে উর্দু-ভাষী বিহারীরা রয়েছেন। এখানে শিয়া সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশ আছে। এমনকি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও রয়েছে। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে সম্প্রীতির বন্ধন রাখতে চাই। এই আসনের মানুষকে আশ্বস্ত করতে চাই, আমাকে মাননীয় নেত্রী মনোনয়ন দিলে জনগণ যদি আমাকে ভোট দেয় তাহলে এলাকাকে আমার মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখব।’
ইতোমধ্যে মনোনয়ন বঞ্চিতদের মধ্যে কয়েকজনকে দ্বাদশের ভোটযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। সারাবাংলাকে দলের একাধিক সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। এই সবুজ সংকেত পাওয়া নেতারা হলেন- জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জাল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, আব্দুর রহমান ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তবে তাদের মধ্যে একজনকে তার আগের সংসদীয় আসনে না দিয়ে অন্য কোনো আসনে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। কিন্তু সেই আসন এখনও নিশ্চিত করা হয়নি।
এদিকে, তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের ক্ষণগননা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে সারাদেশে আনন্দ মিছিল করেছে ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীরা। দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে দেশবাসীকে স্বতস্ফুর্তভাবে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবারের মতো নৌকার নিরঙ্কুশ জয়ের লক্ষ্যে ভোটযুদ্ধে শামিল হবে দলটি। এবারও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সঙ্গে জোটগত ভোট প্রস্তুতির কৌশল নিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হবে শনিবার (১৮ নভেম্বর) থেকে, যা চলবে মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ফরম সংগ্রহ ও জমা দেওয়া যাবে। দলের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। মনোনয়ন বিক্রি ও জমা নেওয়ার পর দলের সংসদীয় বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে। যদিও শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রথম সভা বিকেল ৩টায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে।
শেয়ার করুন