নারীর প্রতি সহিংসতা কেন কমছে না?

জাতীয়

আজ ‘ইয়াসমিন হত্যা দিবস’।  ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। আজ থেকে ২৯ বছর আগে এই ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন পুলিশবাহিনীর কিছু সদস্য এই অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

ইয়াসমিন ২৩ অগাস্ট (দিবাগত রাত) ঢাকা থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে বাসে উঠেছিলেন। তাঁর গন্তব্যস্থল ছিল দিনাজপুরের দশমাইল মোড়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে তিনি অপেক্ষা করছিলেন আরেকটি বাসের জন্য। এক পর্যায়ে সেখানে টহল পুলিশের একটি ভ্যান উপস্থিত হয়। পুলিশের সদস্যরা তাকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পথের মধ্যে পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে ধর্ষণ করে এবং পরবর্তীতে তাকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। পরের দিন সকালে গোবিন্দপুর নামক স্থানে পাওয়া যায় ইয়াসমিনের মৃতদেহ।

ইয়াসমিনের এই ঘটনাকে স্মরণীয় করতেই প্রতি বছর ২৪ আগস্ট দিনটি ‘নারী নির্যাতন ও প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। তবে দিনাজপুরের মানুষ এই দিনটি ‘ইয়াসমিন হত্যা দিবস’ হিসেবেই পালন করে থাকে।

এই ঘটনা ২৯ বছরের আগের। কিন্তু এই ২৯ বছরে কি দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা কমেছে? না, নারী নির্যাতনের মাত্রা মোটেও কমেনি। ইয়াসমিনের মতো অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ধর্ষণের পর মারাও যাচ্ছেন। একমাত্র ভুক্তভোগীই বুঝতে পারেন, কতই না দুর্বিসহ জীবন তাঁকে বয়ে চলতে হয়। এক পর্যায়ে মানসিক ট্রমা তাঁর জীবনের সঙ্গী হয়। এই ট্রমা থেকে উত্তরণের জন্য বিশেষজ্ঞ বা মনোবিদদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমিনের সঙ্গে এই ঘটনা ঘটেছিল। সে অনেক বছর আগের কথা হলেও সেদিন ধর্ষণের মতো অপরাধে যেভাবে মানুষ জড়িত ছিলেন, ঠিক একইভাবে দেশ ও দেশের বাইরের আজও কিছু মানুষ এই ধরণের অপরাধকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কোনো নিয়মকানুন দিয়ে তাদের থামানো যাচ্ছে না।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। চলতি মাসের ৯ আগস্ট ভারতে এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠে ভারত। ভারতের সর্বস্তরের মানুষ এই ধর্ষণ ও হত্যার  বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে।

ভারতের গণমাধ্যমের সংবাদসূত্রে জানা যায়, কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ থেকে গত ৯ আগস্ট কর্তব্যরত এক তরুণী চিকিৎসকের মরদেহ উদ্ধার হয়। প্রথমে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

নিহতের পরিবারকে জানানো হয়, ভুক্তভোগী নারী চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। তবে এই নারী চিকিৎসকের ময়নাতদন্তে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর খবর শোনার পরপরই ক্ষোভে–বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরের মানুষ। এক পর্যায়ে বিক্ষোভ ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নাক-মুখ বন্ধ করে শ্বাসরোধ করার কারণেই (ভুক্তভোগী চিকিৎসকের) তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। চিকিৎসকদের ধারণা, সম্ভবত তাঁকে যৌন নিপীড়ন করা হয়েছিল। ভুক্তভোগীর শরীরে বাহ্যিক ক্ষত যেমন পাওয়া গেছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ ক্ষতও পাওয়া গেছে।

শুধু বাংলাদেশ কিংবা ভারত নয়। বছরের প্রতিটি দিন পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে এই অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটেই যাচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা থামার কোনো লক্ষণ নেই।

এবার দেশের পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখা যাক। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)–এর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন (জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৪) থেকে জানা যায়, এই ছয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৫০ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন নারী। এছাড়া ৫৮ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এ ছাড়া এই ছয় মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ২৬৯ জন নারী। এর মধ্যে ৮৪ জন নারী স্বামী কর্তৃক হত্যার শিকার হয়েছেন। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৯৪ জন নারী। এ ছাড়া যৌন হয়রানি কেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১১৩ জন নারী। এর মধ্যে বখাটেরা লাঞ্ছিত করেছে ১০১ জন নারীকে।

নারীর প্রতি সহিংসতার মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধ হচ্ছে ধর্ষণ। ধর্ষণ সংগঠিত করা, আর কাউকে মেরে ফেলার মধ্যে আসলে খুব একটা পার্থক্য নেই। যারা ধর্ষণ অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তারা কিন্তু এই সমাজেরই মানুষ। প্রশ্ন হলো, সেই পুরুষ মানুষটি কেন ঘটনাস্থলে নিজেকে সংযত করতে পারেন না? কেন তিনি ‘না’ শব্দটি মেনে নিতে পারেন না।

একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখতে পাব, বেড়ে ওঠার পরিবেশের উপর মানুষের আচার, আচরণ ও কথাবার্তা নির্ভর করে। মানুষ ছোটবেলা থেকে যা দেখে বড় হচ্ছে, তা কিন্তু মানুষের মনে সারাজীবন গেঁথে থাকছে। যারা ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িত তারা কিন্তু সমাজে নারীর প্রতি অসম্মান, অন্যায় আচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতার দম্ভ ও আইন অমান্য করার সংস্কৃতি দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে। সমাজের যে মানুষ নারীর প্রতি অমর্যাদা ও অসম্মান দেখতে দেখতে বড় হয়, সেই মানুষ তো সুযোগ পেলে নারীকে নির্যাতন করবেই। তাদের কাছ থেকে তো ভালো কিছু আশা করা যায় না।

তবে ধর্ষণের মতো অপরাধে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণে অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এর মূল কারণ দেশের আইনের শাসনের অভাব। আইন এক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করে। আলোচিত ঘটনা না হলে আইনের মানুষজন চুপচাপ বসে থাকেন বলে অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। তখন এই আইনের ফাঁকফোঁকরে অপরাধীরা পার পেয়ে যান। পরবর্তীতে এসবের কোনো হিসেব থাকে না। ২০১৬ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তনু হত্যা তাঁর জ্বলন্ত প্রমাণ।

শুধু কি তনু? আরও অনেক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার এদেশে হয়নি। আমরা অবশ্য দিনশেষে এসব হত্যাকাণ্ডের কথা ভুলে যাই। তখন আবার নতুন কোনো ধর্ষণের  ঘটনা আমাদের মনকে অস্থির করে তোলে।

অথচ এ দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আছে, ‘যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। আবার যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। আবার যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’

আইন তো আছে। আসলে প্রয়োজন সেই আইনের সর্বোত্তম প্রয়োগ। আমরা চাই না চিকিৎসক মৌমিতা, ইয়াসমিন, তনু বা আফসানার মতো আর কেউ ধর্ষণের শিকার হোক, প্রাণ হারাক। বলতেই হয় যে, এটি তখনই সম্ভব হবে, যখন রাষ্ট্রের সর্বস্তরে নারীর সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *