ভারি বর্ষণে কক্সবাজার শহরের প্রধান প্রধান সড়ক তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অনেক এলাকা। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছে শহরবাসী।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার দুপুর ৪ টা এই (রিপোর্ট) লেখা পর্যন্ত) টানা বৃষ্টিতে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শহরের পাশাপাশি জেলার নিম্নাঞ্চল পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। সঠিকভাবে বৃষ্টির পানি নামতে না পারায় ভোগান্তিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অনেক মানুষ।
এদিকে টানা ভারী বর্ষণে কক্সবাজারে পাহাড়ধসে ৬ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে তিন জন শহরতলির ঝিলংজার দক্ষিণ ডিককুল এলাকায় বাসিন্দা ও তিন জন উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা জেলা প্রশাসন নিশ্চিত করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারী বর্ষণে শহরের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবেছে। শহরের প্রধান সড়ক, সৈকত সড়কসহ অন্তত ৩৫টি উপসড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে কয়েক শ দোকানপাটের মালামাল নষ্ট হয়েছে। হাজারো ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জলাবদ্ধতার কারণে সৈকতে হোটেল মোটেল জোনের ১৮টি সড়ক ডুবে গেছে। পাঁচ শতাধিক হোটেল মোটেলের কয়েক হাজার পর্যটক আটকা পড়েছেন বলে জানিয়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হলেও ভারী বর্ষণ শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে। এরপর রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘণ্টার ভারী বর্ষণ পুরো শহরের আট লাখ মানুষের কর্মজীবন অনেকটাই থামিয়ে দেয়। এমন ভারী বর্ষণ গত ৫০ বছরে দেখেননি কেউ।
ভারী বর্ষণের কারণে শহরের অভ্যন্তরে ১২টির বেশি পাহাড়ে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু অংশে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটছে। গতকাল দিবাগত রাত দুইটার দিকে শহরতলির ঝিলংজার দক্ষিণ ডিককুল এলাকায় পাহাড়ধসে স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমানের পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন মিজানের স্ত্রী আঁখি মণি (২৮), মেয়ে মিহা জান্নাত (১২) ও লতিফা ইসলাম (৯)। পাহাড়ের পাদদেশে মিজানের বাড়িটি ছিল।
কক্সবাজার আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ এ বি হান্নান বলেন, গতকাল সকাল নয়টা থেকে আজ শুক্রবার সকাল নয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজারে ৪০১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চলমান মৌসুমে (২০২৪) এটি (এক দিনে) সর্বোচ্চ বৃষ্টির রেকর্ড। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ গণমাধ্যমে বলেন, আজ সকালে ঝিলংজায় ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত তিন জনের পরিবারকে ৭৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে লোকজনকে সরিয়ে আনা হচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চারটি পৃথক টিম মাঠে নেমেছে।
শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে পুরো শহর ডুবে গেছে। স্থানীয় লোকজন জানান, বেলা ৩টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভারী বর্ষণ নেমেছিল। তাতে শহরের কলাতলী সৈকত সড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। সড়কের দুই পাশের পাঁচ শতাধিক হোটেল গেস্টহাউসে যাতায়াতের অভ্যন্তরীণ ১৮টি উপসড়কও ডুবে যায়। কয়েক হাজার পর্যটক হোটেলে আটকা পড়েন। কলাতলী সড়ক থেকে সমুদ্রসৈকতে নামার সুগন্ধা সড়কটিও ডুবে আছে। সড়কে হাতে গোনা কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) চলাচল করলেও অলিগলিতে ঢুকতে পারছে না।
শহরের ব্যস্ততম পাঁচ কিলোমিটারের প্রধান সড়কও পানিতে ডুবেছে। সড়কের বাজারঘাটা, বড়বাজার, এন্ডারসন সড়ক, টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘিরপাড়, তারাবনিয়াছড়া, রুমালিয়ারছড়ার কয়েক শ দোকান, অফিস-আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি জমে আছে। হাজারো ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।
বাহারছড়া এলাকা বাসিন্দা ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা মুফিজুর রহমান (৫৫) বলেন, এমন ভারী বর্ষণ এ জীবনে তিনি দেখেননি। বর্ষণে তাঁর বসতবাড়িসহ পুরো বাহারছড়া ডুবে গেছে।
পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বন্দরপাড়া, উত্তর নুনিয়াছটার কয়েক শ ঘরবাড়ি বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আকতার কামাল বলেন, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে এই ওয়ার্ডের অন্তত ১০ হাজার ঘরবাড়ি ডুবে যাবে। এই ওয়ার্ডে অন্তত ৭০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু ও ভাসমান শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। রান্নাবান্না বন্ধ থাকায় হাজার হাজার মানুষ খাবার ও পানীয় জলসংকটে আছেন।
পৌরসভার ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, বাদশাঘোনা, খাজা মঞ্জিল, লাইটহাউস, কলাতলী, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, লারপাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় অন্তত ২৩টি উপসড়ক ডুবে আছে। পাহাড়তলী এলাকার ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ি ঢলের পানিতে পাহাড়তলীর তিনটি সড়ক ডুবে কয়েক শ ঘরবাড়ি ও পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। নারী-শিশুরা চরম দুর্ভোগ আছেন।
কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ভারী বর্ষণ হলেই হোটেল মোটেল জোনে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তখন পর্যটকের দুর্ভোগ দেখা দেয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব বিরাজ করে। পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে নালা ভরাট হওয়ায় বৃষ্টির পানি দ্রুত সাগর-নদীতে নেমে যেতে পারে না। তাই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। গত জুলাই মাসেও কয়েক দফায় ভারী বর্ষণ হয়েছিল। তখনো শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল।
এমন জলাবদ্ধতা আর চোখে পড়েনি জানিয়ে শহরের তারাবুনিয়াছড়ার বাসিন্দা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মহিউদ্দিন সোহেল বলেন, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পৌরসভার মেয়রসহ অধিকাংশ কাউন্সিল আত্মগোপনে যান। শহরের ময়লা–আবর্জনায় নালা-নর্দমা ভরে আছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নালা দিয়ে নেমে যেতে পারছে না বলেই শহরজুড়ে এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ যাচ্ছে।
শেয়ার করুন