শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি দেখে বেরিয়ে পড়েন রিকশাচালক ইসমাইল, ফিরলেন লাশ হয়ে

জাতীয়

‘স্বামীর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে গেছি। কীভাবে সংসার চালাব এখন জানি না। নিজেও শারীরিকভাবে অসুস্থ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমার স্বামী। মৃত্যুর দুই মাস পূরণ হয়েছে। অনেকেই যোগাযোগ করছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিন্তু এরপর কোথায় যাব?’

কেঁদে কেঁদে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নিহত ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী লাকী বেগম।

পরিবার বলছে, ইসমাইল হোসেন পরোপকারী মানুষ ছিলেন। যে কারও বিপদ তিনি এগিয়ে যেতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সৃষ্ট সংঘর্ষে যখন শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও তখনকার শাসকদল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুলি করছে, তারা নিহত হচ্ছেন, তখন বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না ইসমাইল। তাই তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন।

১৯ জুলাই বিকালে আসরের নামাজের পর রামপুরা এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। সড়কে শিক্ষার্থীদের পানি পান করাচ্ছিলেন। এমন সময় পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে রামপুরা ডেলটা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত ইসমাইল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার নতুন হাটি এলাকার মৃত ইব্রাহিম খলিলের ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন রাজধানীর রামপুরার ১২ নম্বর উলনপুরে বসবাস করেন। তিনি রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরে রিকশা চালাতেন। পরিবারে স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে আছে তার। মেয়েদের বিয়ে দেন কিছুদিন আগে। ছোট ছেলেকে ভর্তি করান মাদ্রাসায়।

স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, দীর্ঘদিন রামপুরা এলাকায় বসবাস করার কারণে স্থানীয়রা আমার স্বামী ইসমাইলকে শনাক্ত করে। তারা সন্ধ্যার সময় তার মৃত্যুর খবর জানালে আমরা জানতে পারি।

তিনি বলেন, ১৯ জুলাই বিকালে আসরের নামাজের পরেই বাসা থেকে বেরিয়ে যান তিনি। এরপর আন্দোলনে গিয়ে তিনি ছাত্রদের পানি পান করান। হঠাৎ পুলিশের একটি গুলি লাগে তার গায়ে। এরপর অনেকেই তাকে রামপুরার ডেলটা হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বাবার মৃত্যুতে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে ইসমাইল-লাকী দম্পতির একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীরের (১৫)। তাকে মাদ্রাসা থেকে এনে একটি মোবাইল মেকানিকের দোকানে কাজে দিয়েছেন মা লাকী বেগম।

স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে লাকী বেগম বলেন, নতুন সরকারের কাছে আমি অনুরোধ করে বলতে চাই, আমার স্বামী দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। যারা তাকে হত্যা করেছে, আমি তাদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। আসামিদের শাস্তি না হলে আমার স্বামীর আত্মা শান্তি পাবে না।

লাকী বেগম বলেন, সেদিন আমি জানতাম না আমার স্বামী আন্দোলনে যাবেন। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। তিনি ভাত খেয়ে নামাজ আদায় করে আন্দোলনে চলে যান। পরে শুনি সেখানে পুলিশের গুলি খেয়েছেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান।

এ ঘটনায় মামলা করেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার আত্মীয়স্বজন আমাকে নিয়ে যায় হাতিরঝিল থানায়। আমি বাদী হয়ে মামলা করেছি। এতে প্রধান আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। আমি আর বেশি কিছু জানি না কারণ আমি মামলার কাগজ পড়তে পারি না।

এ মুহূর্তে ঢাকার বাসায় আছেন নাকি গ্রামে চলে গেছেন, উত্তরে তিনি বলেন, এখনও কষ্ট করে ঢাকার বাসায় আছি। জামায়াতে ইসলামী ১ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। এ ছাড়া আমার আত্মীস্বজন কিছু সাহায্য করেছে। এভাবে দিন পার করছি। তবে কতদিন এভাবে চলতে পারব জানি না। সরকারের কাছে যোগাযোগ করেছেন কি না বা আবেদন করেছেন কি না, জবাবে তিনি বলেন, আমি তো এসব জানি না। তবে কয়েকজন এসে আমার স্বামীর নাম-ঠিকানা নিয়ে গেছে। কীভাবে দেবে কিছুই জানি না।

সন্তানের পড়ালেখার জন্য মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখা করে আর কী হবে? আগে তার বাবা গিয়ে দেখাশোনা করত, আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়। সন্তান এখন কাজ করে দুই টাকা আয় করলে আমি চলতে পারব। আমার এ পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার চাই।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *