ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যান ভারত। এই অভ্যুত্থানে দেড় হাজারেরও বেশি ছাত্র-জনতা প্রাণ হারিয়েছে। বর্তমানে দেশের হাল ধরেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে আলোচনা উঠেছে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরা ও পরবর্তী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ নিয়ে। সর্বমহল থেকে দাবি উঠেছে ১৪ দল নিষিদ্ধের বিষয়ে।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করছেন, আওয়ামী লীগকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া বা ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা উচিত নয়, কারণ উভয় কর্মকাণ্ডই গণতান্ত্রিক চর্চাকে দুর্বল করবে।
গত ১ অক্টোবর বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন কথা বলেন তিনি।
মির্জা ফখরুল রাজনৈতিক পটভূমিতে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, দলটি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং জনবিরোধী কার্যকলাপের কারণে জনসাধারণ ও তরুণ প্রজন্ম থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সাক্ষাৎকারে তিনি এক-এগারোর মতো একটি সম্ভাব্য বিরাজনীতিকরণের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকতে এবং দায়িত্বশীলভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
ফখরুল বলেন, আমরা যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র চাই, তাহলে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হবে কেন? আওয়ামী লীগের মতো পুরনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে জনগণকে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বোঝাপড়া ও উপলব্ধির ভিত্তিতে মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে। ১৯৭৫ সালে এত বড় ঘটনা ও পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করেনি। নির্বাচনে যোগ দিয়েছে এবং আমি মনে করি, এটাই ছিল দলের জন্য সঠিক কৌশল।
ফখরুল বলেন, নির্বাচন বর্জন গণতান্ত্রিক দলগুলোর জন্য সব সময় সঠিক পন্থা নয়। যদিও কখনও কখনও আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচন বর্জন করা যেতে পারে, যেমনটি আমরা করেছি, এটি একটি বৈধ সিদ্ধান্ত ছিল। যাহোক, যখন একটি দল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তখন পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন উপায় থাকে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ সেই পথগুলোর মধ্যে একটি, যা এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুসরণ করা উচিত।
তিনি উল্লেখ করে বলেন, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বা নির্বাচন থেকে নির্দিষ্ট দলকে বাদ দেওয়ার নেতিবাচক প্রবণতা একটি ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত। উদাহরণস্বরূপ, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা একটি ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলাফল কী হয়েছে? জামায়াত এখন রাজনীতিতে ফিরেছে। সুতরাং, আমি বিশ্বাস করি না যে সরকারের পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত চাপানো সঠিক পদক্ষেপ।
ফখরুল অবশ্য বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যোগ দিলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে নৃশংস কর্মকাণ্ড ও নৃশংস ভূমিকার জন্য দেশের জনগণ তাকে ত্যাগ করবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর একটি খসড়া সংশোধনীর অধীনে আওয়ামী লীগকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার সম্ভাবনা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল স্বীকার করে বলেন, এই পদক্ষেপ একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে প্রস্তাব করা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নিষিদ্ধ করা হবে। তবে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি কতটা উপযুক্ত হবে তা আমি অনিশ্চিত।
নিষিদ্ধের পক্ষে নন জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, রাজনৈতিক চর্চা বাধাগ্রস্ত না হলে দেশের জনগণ যেকোনো দলের অপকর্মের জবাব দেবে এবং ফ্যাসিবাদী দলের কর্মকাণ্ডের মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষেও নই।
গণ-অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। যখন একটি দল আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর খুব বেশি নির্ভর করে, তখন এটি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং গণদাবিগুলো উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো জনগণের সঙ্গে তাদের আস্থা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যাওয়া। যদিও আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে জড়িত থাকতে পারে, তবে দলটি কার্যকরভাবে জনগণের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন এবং অদূর ভবিষ্যতে তাদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না তা অনিশ্চিত।
ফখরুল বলেন, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কোনো একক দল নিতে পারবে না, কারণ এটি ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, যাতে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের প্রবল ক্ষোভের কারণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ জড়িত হয়।
বুদ্ধিজীবী, আমলা ও টেকনোক্র্যাটদের নির্বাচিত গোষ্ঠীর দ্বারা না হয়ে জনগণের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা দেশ পরিচালনা করা উচিত বলে মনে করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
শেয়ার করুন