শীতের শুরুতে বিলের পানি শুকাতে শুরু করলেই গ্রামবাসী মিলে স্থানীয় বিলে দিনব্যপী মাছ ধরার জন্য তারিখ নির্ধারণ করেন। ওই তারিখে বিলে ছেলে বুড়ো মিলে দিনব্যাপী উৎসব আমেজে মাছ ধরেন। এটাই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব। সাধারণত এই উৎস উদযাপন করা হয় মাঘ মাসে। কিন্তু এবার সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার গোয়াহরি গ্রামবাসীকে নির্ধারিত সময়ের চারমাস পূর্বেই উদযাপন করতে হয়েছে পলো বাওয়া উৎসব। কারণ এবছর বর্ষাকালের শেষের দিকেই শুকাতে শুরু করে গোয়াহরি বিলের পানি। পাশাপাশি পানি কমে যাওয়া ও অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে বিলের মাছে মরক দেখা দিলে গ্রামের মানুষ মিলে সিদ্ধান্ত নেন।
গোয়াহরি গ্রামের বাসিন্দা ও দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার গোলাম হোসেন বলেন, প্রায় দুইশত বছর থেকে গোয়াহরি গ্রামের বড়বিলে গ্রামীন ঐতিহ্যবাহী পলো বাওয়া উৎসব পালিত হয় বাংলা বছরের মাঘ মাসের ১ তারিখে। তবে এবছর আর সে নিয়ম রক্ষা করা সম্ভব হয়নি গ্রামবাসীর। বিলে পানি কমে যাওয়া ও অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে বিলের মাছে মরক দেখা দেয়। তাই মাঘে নয় ভাদ্রের শুরুতেই এবার পালিত হয়েছে পলো বাওয়া উৎসব।
অতি তাপমাত্রা ও প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাতের কারণে গোয়াহরি বিলের মতই সিলেটের অন্যান্য বিলের পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় গত কয়েক বছর যাবত বন্যা, তাপদাহ, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, টিলাধসসহ নানা প্রকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে সিলেটে। পরিবেশ ও আবহাওয়াবিধরা বলছেন জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে সিলেটের প্রকৃতিতে। তাই কখনো অতিবৃষ্টি, কখনো অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, নদী ভাঙন, টিলাধসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রকৃতিকে এই বিধ্বংশী আচরণ করছে মানুষজন বাধ্য করেছে। গাছপালা কেটে, নদনদী দখল ও দূষণ করে, পাহাড় টিলা কাটার কারণে প্রকৃতি তাঁর স্বাভাবিক নিয়মে চলতে পারছে নাই। ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। তাই মানবসৃষ্ট এই দূর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে মানুষজকে উদ্যোগ নিতে হবে। পৃথিবীকে মানুষের বসবাস উপযোগী করে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রকৃতিকে তাঁর আপন নিয়মে চলতে দিতে হবে।
সিলেটের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ছিল সম্প্রতি স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহতম বন্যা। দুই দফার বন্যায় সিলেটে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে। বন্যায় মারা গেছেন ৭৮ জন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার।
এদিকে আবহাওয়াবিদদের তথ্য মতে জুন মাসে সিলেটে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৮১৮.৪ মিলিমিটার। কিন্তু চলতি বছর জুন মাসে সিলেটে ১৪৫৬.০২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৩৭.৬২ মিলিমিটার বেশি। উজানের নেমে আসা ঢলের পাশাপাশি এই অতিবৃষ্টিও ছিল সিলেটের বন্যার কারণ।
তাপমাত্রায়ও ৬৫ বছরে রেকর্ড ভেঙেছে সিলেট। গত বছর ১৪ অক্টোবর সিলেটে ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এই রেকর্ড ১৯৫৬ সালের পর অক্টোবর মাসে সিলেটে সর্বোচ্চ রেকর্ড তাপমাত্রা। গত দু তিন বছর ধরে সিলেটে প্রায়ই এরকম তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে রেকর্ড ছাড়ায়।
ভূমিকম্পও পিছু ছাড়ছে না সিলেটেরে। গত বছর ২৯ মে একই দিনে সিলেটে পাঁচবার ভূমিকম্প হয়। ৩০ মে সকালেও কেঁপে ওঠে সিলেট। এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ডাউকি ফল্টের কাছাকাছি থাকা জৈন্তাপুর উপজেলায়। পরে ৭ জুন সন্ধ্যায় মাত্র এক মিনিটের ব্যবধানে সিলেটে আবারও দুই দফা ভূমিকম্প হয়। এছাড়া নদীভাঙন, টিলাধসের ঘটনাতো ঘটছেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে কোন কিছুই আর স্বাভাবিক নিয়মে হচ্ছে না। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন বৃষ্টি হয় না। আবার হলে অতিবৃষ্টি হয়। তাপমাত্রা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করছে সিলেটে। গ্রীষ্মকালে কুয়াশা পড়ে। হাওর বিলে যখন পানিতে থৈ থৈ থাকার কথা তখন দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। এই অবস্থায় বিশ্বনাথে পলো বাওয়া উৎসব অসময়ে হচ্ছে জেনে অবাক হইনি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাপা জাতীয় পরিষদ সদস্য ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক শাকিল বলেন, বিগত কয়েক দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এর বহুমুখি প্রভাব নিয়ে। বাংলাদেশকে এখন আর ছয় ঋতুর দেশ বলা যাবে না। গত এক মাস পূর্বেও সিলেট বিভাগের ৮০ ভাগ এলাকা পানিতে টুইটুম্বুর ছিলো। অথচ শ্রাবণ মাসেই খাল-বিলে পানি নেই। কার্যতঃ জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও আচার-আচরনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে ও ভবিষ্যতে এর আওতা আরও বাড়বে। অদূর ভবিষ্যতে কেবল প্রাণ প্রকৃতি নয়,জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে বদলে দিবে। যার পরিণতি হবে ভয়াবহ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তণ একটি বৈশ্বয়িক সমস্যা। এই জলবায়ু পরিবর্তনের বড় একটি প্রভাব পড়েছে প্রকৃতির উপর। তাই কখনো অতি বৃষ্টি হচ্ছে আবার কখনো তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। ঘন ঘন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণের জন্য দায়ী মানুষ। যেমন প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপূর সিলেটে এখন শহর ও আশপাশের এলাকায় জলাধার নেই। তাই গরমের তীব্রতা বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিনিয়তত গাছপালা, টিলা কাটা হচ্ছে। এসবের প্রভাব পড়েছে সিলেটের প্রকৃতিতে। যেমন এবছর আগস্ট মাসে যে পরিমান বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল সে পরিমান বৃষ্টিপাত হয়নি এখন পর্যন্ত। এখনো স্বাভাবিকের চেয়ে ৭০ ভাগ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। আজ ২১ তারিখ চলে গেছে। সামনে কিছু বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এই বৃষ্টিতে মনে হয় না এমাসের এই বৃষ্টিপাতের ঘাটতি পূরণ হবে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন কোনো আঞ্চলিক বা দেশীয় সমস্যা না। সারা বিশ্ব এই সমস্যার সম্মুক্ষিণ। কোনো ব্যক্তি ব প্রতিষ্ঠান এককভাবে কাজ করে এর সমাধান করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে।
শেয়ার করুন