দ্রব্য মূল্যের উদ্ধগতিতে ভাল নেই বানিয়াচং খেটে খাওয়া মানুষ। আয়ের সাথে ব্যয়ের নেই কোন সমন্বয়, বিপাকে আছে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ব্যবস্থা। নিত্য পন্যের দাম লাগামহীন ভাবে বেড়ে যাওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন বলে অনেকের অভিযোগ।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের ধকল কাটতে না কাটতে আবারও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে খাদ্য সামগ্রী এবং জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উপর।
আর এসব জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে ভাল নেই খেটে খাওয়া বানিয়াচংয়ের শ্রমজীবী মানুষ। সেই সাথে বিপাকে আছে নিন্ম আয়ের এবং মধ্যবিত্ত মানুষজন ও।
যে সব মানুষ সারাদিন কাজ করে ৩শ থেকে ৪শ টাকা মজুরী পায়, দিনশেষে সেই টাকা দিয়ে আয়ের সাথে মিল রেখে সংসার চালানো খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে।
আবার অনেক সময় শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের প্রতিদিন কাজ থাকে না। আর কাজ না থাকলে বাজার সদায় করা হয় না। হয়তো ধারকর্জ করে বাজার করতে হয়। অন্যদিকে ৩শ টাকার মজুরি পেলেও সংসার চলে না তাদের।
একজন মানুষ চাইলেও সপ্তাহে ৭ দিন কাজ করতে পারে না। মাঝে মাঝে রেষ্ট থাকতে হয় আবার অনেক সময় কাজ থাকে না। আর পুরো সপ্তাহ কাজ না করলে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয় তাদের। অনেক সময় বাধ্য হয়ে কোন না কোন এনজিও সংস্থার কাছে থেকে উচ্চ হারে সুদে ঋণ নিয়ে সংসারে খরচ চালাতে হয়।
এমনও দেখা যায় একজন মানুষ কয়েটা এনজিও সংস্থা থেকে একের পর এক ঋণ নিয়ে থাকে। পরবর্তীতে ঋণের বোঝা এত হয়,তখন বাধ্য হয়ে ভিটামাটি বিক্রির করার অনেক প্রমান পাওয়া যায়। আবার অনেক ঋণের কারনে দেশান্তরি হয়েছেন এমন অনেক নজির আছে। তাই সব মিলিয়ে ভাল নেই এসব নিম্ন আয়ের মানুষ গুলো।
বানিয়াচং উপজেলা একটি হাওর বেষ্টিত এবং কৃষি প্রধান এলাকা। এখানে ৬ মাস কাজ থাকে আবার ৬ মাস কোন প্রকার কাজ থাকে না। শ্রমজীবী মানুষ এই ৬ মাস খুবই কষ্টে কাটে তাদের জীবন। কিছু মানুষ আছেন বর্ষাকালে হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন, আর সেই মানুষের সংখ্যা খুবই নগন্য। বাকী মানুষ বেকার বসে সময় পার করেন।
আবার গ্রামের কিছু মানুষ বানিয়াচংয়ের বাহিরে রাজমিস্ত্রী বা অন্য কাজে যুক্ত থাকেন।
জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধির ফলে বেড়ে গেছে সকল পরিবহনের ভাড়া। তার সাথে সাথে ভাড়া বেড়ে গেছে সকল পন্যবাহী যানবাহনের। ফলে নিত্যপণ্যে মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এবং তার প্রভাব পড়ছে বাজারে সকল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের উপর।
বাজারে এমন কোন জিনিস নাই যেটার দাম বাড়েনি। মাছ তরকারি সহ সকল পণ্যের লাগামহীন ভাবে দাম বেড়ে যায়। বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধির ফলে ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে।
প্রতিটি পণ্যের লাগামহীন ভাবে দাম বেড়ে গেছে। এখন আর ব্যাগ ভরে বাজার করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। আয়ের সাথে ব্যয়ের সংকুলান না হওয়ায় প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার ক্ষমতা নেই অনেকেই।
আপাতত পেয়াজ রসুন এবং আদা জাতীয় মসলার বাজার কিছুটা স্বস্তিতে আছে। আটা ময়দা চিনি পেকেটজাত দুধ সেমাই নুডলস এবং বিস্কুট এখন আর গরীব মানুষের খাবারের তালিকায় রাখার সুযোগ নেই। যদিও এসব নিত্য খাবার নয়। তবে বাড়িতে শিশু বাচ্চা বা অতিথি আসলে এগুলো দিয়ে আপ্যায়ন করার রীতি আমাদের। বাজারে সয়াবিন তেল তো আর কেনার মত সামর্থ্য অনেকেই হারিয়েছেন, এখন অনেক মানুষ সয়াবিন তেল কিনতে হলে পকেটের দিকে আগে তাকিয়ে দেখেন তেল কেনার বাজেট পকেটে আছ তো! তার সাথে পামওয়েল এবং সরিষা তেল অস্বাভাবিক ভাবে দাম বেড়েছে। তেল কেনার পর অন্য জিনিস পত্র কেনার চিন্তা করতে হয়।
এখন আসা যাক মাছের বাজারের দিক, এখন বর্ষা মৌসুম হওয়ার মাছের বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে, চাইলে কমদামে কেনার সুযোগ পাওয়া যায়। সেটার আবার কয়েক মাস এই সুবিধা পাওয়া যাবে, পরবর্তীতে সেই সুযোগ আর থাকে না। তখন নিম্ন আয়ের মানুষদের একমাত্র পাঙ্গাশ মাছ ই ভরসা। এর বাহিরে অন্য মাছের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
লোকমুখে প্রচলিত আছে পাঙ্গাশ মাছ নাকি গরীবের মাছ! এই মাছ গরীব মানুষদের কে টিকিয়ে রাখতে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এত গেল মাছে গল্প, এখন আসা যাক সবজি বাজারে দিকে। আপনি সীমিত আয়ের মানুষ, কি সবজি কিনবেন?
আসুন জেনে নেয়া যাক কোন সবজির কত দাম। আলু ৩০ টাকা টমেটো ৯০/১০০ টাকা শীম ১৩০ টাকা, গাজর ১৪০/১৫০ টাকা শসা ৬০ টাকা বেগুন ৪০/৫০ টাকা মুকি ৪০ টাকা
ঢেঁড়শ ৪০/৫০ টাকা মুলা ৪০ টাকা বরবটি ৫০ লেবু ২০/৪০ টাকা হালি এবং চিচিঙ্গা ৫০ টাকা কেজি সহ প্রায় সবজি আপনাকে ৫০ টাকা বেশি দামে কিনতে হবে।
এখন আসি একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের কাছে, আর তিনি হলেন কাচা মারিচ, উনার ঝাঁঝের কাছে যাওয়া মানে মহা বিপদ। (উনি কিন্তু সবজি জাতীয় খাবার) এই কাঁচামরিচ কিনতে হলে তো আপনাকে ২ শ থেকে ২ শ ৮০ টাকায় কিনতে হয়। এবার বুঝুন তার কি ঝাঁঝ। এভাবে যদি কাঁচামরিচের দাম বাড়তে থাকে তা হলে আগামী তে হালি হিসাবে কাঁচা মরিচ কিনতে হবে!
অথবা সীমিত আয়ের মানুষ এই মহামূল্যবান দ্রব্য টি খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হবেন।
আরেকটি পণ্যের কথা আপনাদের কে স্বরণ করে দিই, সে খাদ্য থেকে আমারা প্রচুর পরিমান প্রোটিন পেয়ে থাকি, আর সেটা হল ডিম। এই ডিম কিনতে হলে আপনাকে প্রকার বেধে ৫০/৬০ হালি টাকায় কিনতে হবে। আপনার ঘরে বাচ্চাদের প্রোটিন অভাব পূরণে এখন হালি হিসাবে কিনবে না ১ টা করে ডিম কিনবেন সেটার আপনাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে?
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বাজারে এত আগুন, সেই আগুন কবে যে নিয়ন্ত্রণ আসবে সেটা উপরওয়ালা জানেন!
এবার আসা যাক প্রসাধনী এবং মনোহারী জিনিসপত্র দিকে, ব্যবহারে জন্য কিছু মনোহারী জিনিস আছে, সেটার কেনার জন্য আপনাকে পূর্ব প্রস্তুতি নিতে হবে, আপনার বাড়ি থেকে বলা হল গায়ে মাখার সাবান আনতে। একটি লাক্স সাবান এখন কিনতে হলে ৫৫/৭০ টাকায় কিনতে হয়। কিছুদিন আগেও এই সাবান ৪০/৪২ টাকায় কেনা যেত। এটা শুধু একটা সাবানের মূল্যের উদাহরণ দিলাম। যারা এসব মনোহারী জিনিস কিনেন তারা জানেন কি অবস্থা এসব পণ্যের। প্রত্যেকটি জিনিসের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা এবং প্রকারভেদে আরো বেশি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে।
(আমার ছেলে বাথরুমে গিয়ে তার মায়ের অগোচরে স্কুল ড্রেস প্রায় সময় গায়ে মাখার সাবান দিয়ে ধুয়ে থাকে, আমি একদিন দেখে ছেলে কে বললাম বাবা, আর গায়ের মাখা সাবান দিয়ে ড্রেস ধুইয়ো না, লাক্স সাবান এখন ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে) দুঃখিত আম এই বিষয়টি মজার চলে উল্লেখ্য করলাম।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতির এমই হাল।
একজন শ্রমজীবী মানুষ ৩ শত থেকে ৪টাকা দৈনিক আয় করলে এই বাজার মূল্যের উর্ধগতিতে কি ভাবে সংসার চালাবে এটা এখন বড় প্রশ্ন?। আয়ের সাথে ব্যয়ের সংকুলান না হওয়ায় চরম বিপাকে আছে নিম্ন এবং মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষজন। সবার একটা দাবী, কবে মিলবে মুক্তি। এখন সেই সুদিনের আশায় বসে আছে শ্রমজীবী মানুষ।
বিভিন্ন এলাকার শ্রমজীবী মানুষদের সাথে কথা বলে,তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।
লোহাজুড়ি গ্রামের দিনমজুর আজগর আলী জানান, আমরা গ্রামের মানুষ, ৬ মাস কৃষি কাজ করি এবং বাকী ৬ মাস বসে খাই, কোন কাজ থাকে না। আয় রোজগার নাই, জিনিসপত্রে দাম বেশি হওয়ায় ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসারে ৩ বেলা খেয়ে বেঁচে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ছে।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক সফিকুল বলেন, সারাদিন টমটম চালিয়ে যে পরিমান টাকা পাই, তাই দিয়ে সংসার চালনো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারের কাছে দাবী দ্রুত জিনিস পত্র দাম কমানো হউক, অন্যথায় ছেলে মেয়ে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
কার চালক নুর মিয়া বলেন, মালিকের গাড়ী চালিয়ে যে বেতন পাই, সেই টাকা সংসারের খরচ চালাতে পারছি না। এখন আগের মত গাড়ী রিজার্ভ ও হয় না। তাই জিনিস পত্রের দাম কমানো খুবই জরুরী।
রাজমিস্ত্রী মহিস মিয়া জানান, রাজের কাজ করে যে পরিমান টাকা পাই, সেই টাকায় খরচের পর ছেলে মেয়ে নিয়ে কোলাইয়ে উঠতে পারছি না। এভাবে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় ঠিকমত বাজার করতে পারি না।
দোকান কর্মচারী অমল দেব জানান, যেভাবে দ্রব্য মূল্যে বেশি হওয়ায় আমার মত সীমিত বেতনের মানুষ চলতে খুবই কষ্ট হয়। ইচ্ছে মত নিত্য প্রয়োজনীয় কিনতে হিমসিম খাচ্ছি। দ্রুত দাম কমানোর দাবী তার।
ঠেলা চালক সাবু মিয়ার কথায় হতাশার সুর, তিনি বলেন আমরা খুবই সীমিত আয়ের মানুষ, ঠেলা চালিয়ে দিনে ৩ শ বা চেয়ে কিছু পাই, এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে পারি না, দাম বেশি হওয়ায় ছেলে মেয়ের জন্য চাহিদা মত জিনিস কিনতে পারি না।
সিএনজি ড্রাইভার, মুছা বলেন, গাড়ী চালিয়ে যে বেতন পাই, মালিকের টাকা দেয়ার পর সামান্য থাকে সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তার ভাষায়, তাড়াতাড়ি দাম কমানো হউক।
এরকম অনেক শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে সবার মুখে শুধু হতাশার সুর। তাদের একটাই দাবী, আমরা শ্রমজীবি মানুষ, আমাদের আয় সীমিত, তাই দ্রুত জিনিস পত্রের দাম কমানোর জোড় দাবী।
পরিশষে একটি গানের কলি দিয়ে শেষ করব, বাউল সম্রাট, মরমী কবি, শাহ আবদুল করিমের গানের চরণ দিয়ে শেষ করছি।
করি ভাবনা সেদিন আর পাব না,
ছিল বাসনা সুখী হইতাম….
“আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা”