কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু লাপাত্তা,ক্ষমতার দাপটে কোটিপতি

মৌলভীবাজার

 

কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু (৭৪) একসময় একটি মুদির দোকানের কর্মচারী ছিলেন। তবে গত তিন দশকে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে পুঁজি করে কোটিপতিতে পরিণত হয়েছেন। চাকরি বা নিজস্ব কোনো ব্যবসা ছাড়াই ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজির মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। আলিশান বাড়ি, একাধিক প্লট, উপহার পাওয়া গাড়ি এবং নামে-বেনামে অসংখ্য সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তিনি।

দলীয় প্রভাব খাটিয়ে পুরো উপজেলায় তার একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে রফিকুল ইসলাম রেনু গা ঢাকা দিয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মী, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি বয়স্কদের নাম ধরে ডাকতে ও ‘তুই-তুকারি’ করতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি, যা মৌলভীবাজারের সাধারণ মানুষ জানে।

জানা যায়, রফিকুল ইসলাম রেনু দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে বেড়ে ওঠেন।

তার বাবা মরহুম মদচ্ছির আলী কৃষকদের ধান ও মালপত্র পরিবহনের জন্য ঘোড়া ব্যবহার করতেন। বাবার বসতভিটার জায়গা ছাড়া অন্য কোনো সহায়-সম্পদ তাদের ছিল না। জীবিকার প্রয়োজনে ১৯৭৬-৭৭ সালে তিনি ফুলতলা বাজারের একটি মুদির দোকানে কর্মচারীর কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে কুলাউড়ার সাবেক এমপি মরহুম আব্দুল জব্বারের হাত ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন।
১৯৯২ সালে আব্দুল জব্বার মারা গেলে রফিকুল ইসলাম রেনু উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৯৭ এবং ২০০৪ সালের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের সম্মেলনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন, যা তার ক্ষমতা এবং সম্পদ বৃদ্ধির পথ আরও প্রসারিত করে। এর আগে তিনি তিনবার ভূকশিমইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রফিকুল ইসলাম রেনুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বিএনপি-জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী হামলা-মামলার শিকার হন।

২০১৩ সালে হরতাল-অবরোধ চলাকালে টিলাগাঁও ও ছকাপন এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনার দায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের ওপর চাপিয়ে তিনি মামলা বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। তার ইন্ধনে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী জেল খাটতে বাধ্য হন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিরোধিতাকারী ছিলেন রেনু

সারাদেশের মতো কুলাউড়াতেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘোর বিরোধিতাকারী ছিলেন কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু। গত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে শিক্ষার্থীদের হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং হুমকি দেওয়ার অভিযোগে রেনুসহ দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। মামলা দায়েরের পর থেকেই রেনু লাপাত্তা রয়েছেন।

মামলায় উল্লেখ করা হয়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিপার উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে কুলাউড়া শহরে মিছিল করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়।

উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা সুফিয়ান আহমদ অভিযোগ করে বলেন, “ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে কুলাউড়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা রেনুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে আমার বিরুদ্ধে নাশকতাসহ মোট ২২টি মামলা করা হয়। এসব মামলার কারণে আমাকে সাতবার জেলে যেতে হয়েছে। আমার নিরপরাধ দুই ভাই বুরহান ও শাহানকেও জেল খাটতে হয়েছে। এমনকি আমার ব্যক্তিগত গাড়িতে হামলা চালিয়ে সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আমার মতো অসংখ্য নেতাকর্মী হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন।”

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক ফজলু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ইতিহাস কখনো লুকানো যায় না। কুলাউড়ায় এমন কোনো অপকর্ম নেই যা রফিকুল ইসলাম রেনু করেননি। দলের স্বার্থের তোয়াক্কা না করে তিনি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পছন্দের লোকদের উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে পদ দিয়েছেন। ক্ষমতার প্রভাবে তিনি পদ বাণিজ্য, মামলা বাণিজ্য, এমনকি নমিনেশন বাণিজ্য করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েছেন।”

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এবং কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ রহমান আতিক বলেন, “কুলাউড়ায় রাজনীতিকে পুঁজি করে রফিকুল ইসলাম রেনু অনেক অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন। তার কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। কুলাউড়ায় রাজনীতির দুর্নীতির ইতিহাসে যদি কারও নাম প্রথমে আসে, তবে সেটা হবে রফিকুল ইসলাম রেনু।”

রফিকুল ইসলাম রেনুর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা রফিকুল ইসলাম রেনু। আব্দুস শহীদের কাছের লোক হওয়ায় কুলাউড়ায় তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে একক আধিপত্য বিস্তার করেন।

পৌর শহরের ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে অবস্থিত জেলা পরিষদের জায়গায় ২০০১ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে বিএনপির কার্যালয় ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেনু ওই বিএনপি অফিসটি জোরপূর্বক দখল করে আওয়ামী লীগের অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি নেতা আব্দুল মুনিম জেলা পরিষদ থেকে অফিসটি লিজ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রেনু ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে লিজভুক্ত ওই অফিস দখল করেন এবং টাইলস লাগানোর নাম করে দলীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন। দখল করা অফিসের সামনেই তিনি একটি ফলের দোকান ভাড়া দেন।

তবে গত ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা ওই আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালালে বিএনপি নেতা আব্দুল মুনিম পুনরায় অফিসটি নিয়ন্ত্রণে নেন।

এছাড়া রেনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি ভূকশিমইল নবাবগঞ্জ বাজারের পাশে ফানাই নদীর তীরবর্তী সরকারি রাস্তার জমি দখল করে নিজের গ্রামের বাড়ি ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছেন। যেখানে সরকারি রাস্তা ২৪ ফুট থাকার কথা, সেখানে রেনুর কারণে তা ১২ ফুটে নেমে এসেছে। এলাকাবাসীর মধ্যে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ থাকলেও রেনুর প্রভাবের কারণে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করেনি।

রেনু তার নিজ এলাকায় বঙ্গবন্ধু আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নিজের ছোট ভাই মোজাহিদুল ইসলামকে প্রধান শিক্ষক এবং নিজেকে সভাপতির পদে বসিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন। একইভাবে ভূকশিমইল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতির পদে থেকে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

তৎকালীন সাবেক এমপি নওয়াব আলী আব্বাস খান ও মো. আব্দুল মতিনের সময় ভূকশিমইল ইউনিয়নে নামমাত্র প্রকল্প গ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন রেনু। নিজের ভাই মোজাহিদুল ইসলামকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জালালাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন।

এছাড়াও বিচারের নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ রেনুর বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

রফিকুল ইসলাম রেনুর দৃশ্যমান সম্পদ

ঢাকার উত্তরায় রফিকুল ইসলাম রেনু একটি অবৈধ ফ্ল্যাট কিনেছেন, যা গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় প্রকাশ্যে আসে। কুলাউড়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের শিবির এলাকায় তাঁর একটি আলিশান তিনতলা ভবন রয়েছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য জমিসহ প্রায় দুই কোটি টাকা।

উত্তর কুলাউড়ার জয়চণ্ডী সড়কে ডা. মবশিরের বাড়ির পাশে ৮ শতক জমি এবং একই এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক মইনুল ইসলাম সোহাগের বাসার নিকট ১৫ শতক জমি রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা। উত্তর কুলাউড়ায় বিএনপি নেতা রফিক মিয়ার বাড়ির পাশে ১০ শতক জমি রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা। ভূকশিমইল ইউনিয়নের রসুলগঞ্জ বাজারে আকমলের ঘরের পাশে তাঁর একটি প্লট রয়েছে। এছাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে আরও বহু সম্পদ রয়েছে।

রফিকুল ইসলাম রেনুর বিরুদ্ধে উত্থাপিত এসব অভিযোগের বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সুত্র : কালেরকন্ঠ।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *