রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার নাম, এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোনো ভূখণ্ডের অধিবাসীরা তাদের আর্থসামাজিক যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আল্লাহ সুবহানাওয়াতায়ালা নবী-রাসুলদের মাধ্যমে পরিচালনা করেছেন ও শিক্ষা দিয়েছেন। জাহেলি যুগে আইনপ্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কোনো উপযুক্ত ক্ষেত্র ছিল না, নবীজি সে সময় আরবের সেই রুক্ষ, কঠোর, পশ্চাৎপদ হিংস্র জাতিকে এমনভাবে গঠন করেছিলেন-‘উন্নয়ন সমৃদ্ধিতে সেই জাতি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করেছিল।’
রাব্বুল আলামিন একান্ত নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিক্ষাদান করেছেন এবং মানবতার মহান শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন। নবীজি স্বীয় বের আদেশে মদিনা নামের একটি কল্যাণময় রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন, ইসলাম আবির্ভাবের সেই অন্ধকার অবস্থা বর্তমানে আধুনিক জাহেলিয়াতের মোড়কে দুনিয়ার সামনে এসেছে, সীমান্ত এবং মতানৈক্য বিভক্ত করেছে আজ মুসলিম জাতিকে। ইসলামে ‘বিচার আদালত কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংঘ দ্বারা সম্পন্ন হওয়া বিধেয়’। নিজস্ব ইচ্ছাধীন হলে এতে জুলুম ও বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতার সমূহ আশঙ্কা বিদ্যমান থাকে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (বোখারি : ২৫৫৪)
আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ (৩৩ : ২১)
শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাইয়্যেদুল মুরসালিনের শাসন পদ্ধতি অনুসরণের বিকল্প নেই। নবীজির রাষ্ট্রনীতির Term বর্ণনা করা হলো-
১. সার্বভৌমত্ব : রাসুল (সা.) রাষ্ট্রের জনগণকে এ সত্য বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, মহান রাব্বুল আলামিন সব ক্ষমতার উৎস। মানুষ কোনো মানুষের দাস হতে পারে না, কারো গোলামিও করতে পারে না, দাসত্ব শুধু আল্লাহর জন্য।
২. নেতা নির্বাচন : মদিনার মসজিদ ছিল পরামর্শ পরিষদের সভাকেন্দ্র। রাসুল (সা.) নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বলেছেনÑ ‘আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি এ দায়িত্বপূর্ণ কাজে এমন কাউকে নিয়োগ করব না, যে এ কাজে নিজ থেকে প্রার্থী হতে আগ্রহী।’ অথচ দেখা যাচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্রে এখন নিজে প্রার্থী হয়ে নেতা হতে দৌড়ঝাঁপ করে এবং তাকেই প্রার্থী নির্বাচন করা হয়।
৩. শূরা গঠন : উপদেষ্টা পরিষদের ইসলামি পরিভাষা হলো ‘মজলিসে শূরা’। মজলিস অর্থ সভা, পরিষদ, আর ‘শূরা’ অর্থ পরামর্শ। মজলিসে শূরার অর্থ হচ্ছেÑ পরামর্শ পরিষদ। এখানে অধিকাংশের অংশগ্রহণ থাকে এবং এখানে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা থাকেন। নবীজির প্রতি রবের আদেশ ছিল, ‘তিনি যেন সব কার্যাবলির ক্ষেত্রে পরামর্শ করা অব্যাহত রাখেন, রাসুল (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করতেন।
৪. একটি স্থায়ী নীতি : কোরআন নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে এবং পরামর্শকে সাফল্যের চাবিকাঠি আখ্যায়িত করে পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বলেছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলে, যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে, তখন তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদের ক্ষমা করো, তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করো এবং কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে-ইমরান ১৫৯)। ইসলাম নির্দেশিত এই পরামর্শ ব্যবস্থা নিজ পরিবার, সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্রÑ সব ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যদি পরামর্শ ব্যবস্থা দুর্বল হয়, তাহলে পারিবারিক কলহ, সামাজিক অশান্তি, রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা, পরনিন্দা, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি এসব দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাবে। পরামর্শের অনুপস্থিতিতে একটি আদর্শবাদী সংগঠনের পরিকাঠামো ভেঙে পড়া অবশ্যম্ভাবী।
৫. সন্ত্রাস প্রতিরোধ : সন্ত্রাস প্রতিরোধে তরুণ বয়সে নবীজি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন সমগ্র জীবনে পরিলক্ষিত হয়। সিরাতে রয়েছে রাসুল বলেছেন, ‘আজও যদি কোনো উৎপীড়িত ব্যক্তি ‘হিলফুল ফুজুল প্রতিজ্ঞার ব্যক্তিবর্গ’ বলে ডাক দেয়, আমি অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দেব, ইসলাম এসেছে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অত্যাচারিতকে সাহায্য করতে।’
৬. আইন প্রয়োগ পদ্ধতি : নবীজি নবুওয়াত লাভের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত অহিভিত্তিক ফর্মূলা অনুযায়ী বিশ্বকে গড়ে তোলার জন্য সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত করেন, সিরাতের ঘটনায় উল্লেখ রয়েছে-
‘বনী মাখজুম গোত্রের একজন নারী চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তার দণ্ডাদেশ মওকুফ করার ব্যাপারে নবীজির কাছে উসামা ইবনে জায়েদের মাধ্যমে সুপারিশ করার অনুরোধ করেন, রাসুল (সা.) তার সুপারিশ শোনে বললেন, আল্লাহর ঘোষিত দণ্ডবিধি কার্যকরণের ক্ষেত্রে তুমি কি সুপারিশ করছো? জেনে রাখো, আল্লাহর কসম! যদি মোহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত, অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।
রাসুল (সা.)-এর রাষ্ট্রনীতিতে আরো ছিল শিক্ষাব্যবস্থা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ ও উৎসাহ প্রদান, মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার নিশ্চিতসহ রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ কাজ।
আলোচিত প্রেক্ষাপট অনুযায়ী গণতন্ত্র একটি সংবিধান। এ গঠনতন্ত্রের নীতি সরকার পরিচালনার জন্য লোক মনোনীত করে, কিন্তু ইসলাম সবার সম্মতিতে মনোনয়নের ফলাফলকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। গণতন্ত্র নামক অট্টালিকার এমন একটি বহির্ভাগ তৈরি করা হয়। যার ফলাফল দাঁড়ায়Ñ ধনাঢ্যতম দেশে অকথ্য দারিদ্র্যের এক জঘন্য দৃশ্যরূপ। গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল এই মহান উদ্দেশ্য নিয়ে, এই পথে স্বেচ্ছাচারী শাসকদের নির্যাতনের অবসান ঘটবে। কিন্তু অন্য যেকোনো সামাজিক সংস্কার-আন্দোলনের ক্ষেত্রে যা হয়, মহান সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্কহীন এই গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও তাই-ই ঘটেছে। আল্লাহর আইনের বাস্তবায়ন ছাড়া কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব।
শাসন এবং শাসকের দায়বদ্ধতার শিক্ষায় বিশ্বকে সজাগ করতে বিশ্বের প্রয়োজন ইসলামের কাছে ফিরে আসা। দুর্ভাগ্যবশত, গণতন্ত্রের মৌখিক আশ্বাসে আজ আমরা এতটাই মগ্ন ও মুগ্ধ যে, নির্বাচনী পন্থাকেই আমরা জরুরি মনে করছি, যা সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ সরকার প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা থেকে আমাদের দৃষ্টিকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ইসলাম একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান, যা খোদাভীরু লোকদের মতবিনিময়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ইনসাফ করো, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ইনসাফকারীকে ভালোবাসেন। (সুরা : হুজুরাত : ৯)
নবীজির ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, কথা ও কাজের মধ্যে ঝকঝকে আয়নার মতো কোরআনই প্রতিবিম্বিত হয়েছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শাসকের দায়বদ্ধতায় রাসুল যে অনুপম দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা সর্ব যুগের সব নেতার জন্য অনুসরণীয় ও একমাত্র আদর্শ।
শেয়ার করুন