প্রায় আট একর জায়গাজুড়ে বিশাল পুকুর। পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে তাকালে ভেসে ওঠে পিলার ও গম্ভুজের তৈরি দৃষ্টিনন্দন প্রাচীন মসজিদের প্রতিচ্ছবি। মসজিদের ঠিক পেছনে দাড়িয়ে আছে আসাম প্যাটার্নের তেরোচালা টিনের ঘর। কাঠ-বাশের খানার ওপর চুনসুরকি ব্যবহৃত ঘরটিতে রয়েছে নানা কারুকার্য। তার পাশেই শুধুমাত্র ইট ও কাঠের দিয়ে তৈরি একটি বিশাল বিচারালয়। সতেরো শতকের প্রথম দিকে নির্মিত এই প্রাচীন মসজিদটি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার সাজিদ রাজার বাড়ির একটি অংশ।
সুরমা নদীর তীরবর্তী এলাকার এই বাড়িটি সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি অংশ। অযতœ, অবহেলা ও সংরক্ষণের অভাবে ইতিহাসের সাক্ষি সেই জমিদার বাড়িটি এখন প্রায় ধ্বংসের পথে। পরিত্যক্ত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকেও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ছে। তাইতো প্রতিদিনই দুর দুরান্ত থেকে অনেক পর্যটক আসেন এই বাড়িটি দেখতে।
জানা গেছে, সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে জকিগঞ্জ উপজেলা ও এর আশপাশ শাসন করতেন জমিদার সাজিদ রাজা। প্রজাদের দেখভাল করার জন্য কাঠের তৈরি গাড়ি ও হাতির উপর চড়ে রাজ্য ঘুরে বেড়াতেন। ব্যক্তিজীবনে রাজা ছিলেন চিরকুমার। রাজার রাজবাড়ি ছিলো প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে। এই বাড়িতে রয়েছে তেরোচালার একটি টিনের ঘর। ব্রিটিশ আমলে জমিদার সাজিদ রাজার বোনের উত্তরাধিকারীরা শখের বশে এই ঘর তৈরি করেন। তৎকালীন ১৩ হাজার টাকা মজুরিতে কলকাতার মিস্ত্রিরা তেরোটি চাল তৈরি করেন।
এছাড়া ধর্মপ্রাণ সাজিদ রাজা নামাজ পড়ার সুবিধার্থে ১৭৪০ খৃষ্টাব্দে তার বাড়ির সামনে পিলার ও গম্ভুজের তৈরী দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদটি নির্মাণ করেন। সাধারণ মানুষের পানির জন্য বাড়ির সামনে প্রায় ৮ একর ভূমিজুড়ে একটি বিশাল পুকুর খনন করেন রাজা। প্রজারা সেই পুকুরের পানি খেয়ে তৃঞা নিবারণ করতেন। আজও সেই পুকুরের পানি ব্যবহার করেন রাজার বাড়ির আশেপাশের মানুষজন। আর মসজিদে নামাজ পড়েন পুরো গ্রামের মানুষ। সরেজমিনে দেখা গেছে, তিনশত বছরের বেশি পুরোনো রাজবাড়িটি এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় দখল করে নিয়েছে সেই ১৩ চালার টিনের ঘর। অযতœ অবহেলার চিহ্ন নিয়ে আজও দাড়িয়ে আছে রাজার সেই বিচারালয়। তবুও প্রাচীন এই স্থাপনাটি পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক ভ্রমণপিপাসুরা দেখতে আসেন এই রাজ প্রাসাদটি।
বর্তমানে জমিদার সাজিদ রাজার বাড়িতে তার কোনো বংশধর থাকেন না। সবাই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে গেছেন। অনেক আবার বিদেশে অবস্থান করছেন। শুধুমাত্র রাজার বোনের বংশদরদের মধ্যে সারোয়ার হোসেন চৌধুরী নামে একজন বাড়িতে অবস্থান করেন। ব্যক্তি জীবনে জীবনে তিনিও চিরকুমার।
সাজিদ রাজার বংশধর সিলেটের মতিন উদ্দিন আহমদ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফা শাহ জামান জানান, ১৭০০ শতকের শুরুর দিকে জমিদার সাজিদ রাজা এই অঞ্চলে শাসন করতেন। রাজা চিরকুমার থাকায় তার বিশাল সম্পত্তি চার ভাগনের মধ্যে বন্টন করে দেন।
তিনি বলেন, এই প্রাচীন স্থাপনাগুলোর সাথে সাজিদ রাজার অনেক স্মৃতি রয়েছে। তিনশত বছরের বেশি পুরনো এসব স্থাপনা আমাদের ঐতিহ্যের একটা অংশ। সরকারিভাবে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর এগুলোকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এর প্রধান সমন্বয়ক গবেষক আব্দুল হাই আল হাদী জানান, আমি এই প্রাচীনতম স্থাপনাটি ঘুরে দেখেছি। এটি আমাদের একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। অবিলম্বে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষণ করা উচিত। তাছাড়া এটিকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে মানুষ সাজিদ রাজা সম্পর্কে আরো জানতে পারবে। আমদের এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
শেয়ার করুন