কুলাউড়ার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া খাবার সরবরাহে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগেও অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে।জানা গেছে, হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ বিভাগে ভর্তি থাকা রোগীদের ওষুধের পাশাপাশি প্রতিদিন সরকারিভাবে ১৭৫ টাকা মূল্যের তিন বেলা (সকালে নাশতা, দুপুরে ও রাতে ভাত) খাবার দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিশেষ দিবসে প্রত্যেক রোগীকে ২০০ টাকায় খাবার দেওয়া হয়।
টেন্ডারের শর্ত অনুয়ায়ী হাসপাতালটিতে সপ্তাহে তিন দিন দুপুর ও রাতে প্রত্যেক বেলায় ১৭৫ গ্রাম করে ভাত ও ৭৫ গ্রাম করে মুরগির মাংস দেওয়ার কথা। কিন্তু মাংস পরিমাণ মতো দেওয়া হচ্ছে না। সপ্তাহে চার দিন দুপুর ও রাতে ১৭৫ গ্রাম করে ভাত, ৭৫ গ্রাম করে মাছ দেওয়ার কথা। প্রতিদিন রোগীদের সকালে দুই পিস পাউরুটি, একটি সিদ্ধ ডিম, দুইটি পাকা কলা দেওয়ার কথা।
কিন্তু এখানে ছোট আকারের কলা ও নিম্নমানের পাউরুটি দেওয়া হচ্ছে। আর মাছ-মাংসসহ মোটা চালের ভাত, পচা-বাসি তরকারিসহ নিম্নমানের খাবার দেওয়া হচ্ছে বলে রোগীদের অভিযোগ।হাসপাতালের বাবুর্চি সাজিয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন রোগীদের খাবারে সবধরণের উপকরণ কম দেওয়া হয়। মাছ-মাংস একজন রোগীর প্লেটে দুুপুরে ও রাতে ১৫০ গ্রাম দেওয়ার কথা।কিন্তু দেওয়া হয় ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম পর্যন্ত। প্রতিদিন সকালে নিম্নমানের পাউরুটি, ছোট সাইজের কলা দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী বলেন, এখানে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্সের মুক্তার আহমদ কাগজে কলমে খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পেলেও হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক আলমাছুর রহমান তাকে সহযোগিতা করছেন। তাদের দুইজনের যোগসাজশে নিম্নমানের খাবার দিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে নিচ্ছেন। বেশি কিছু বলতেও পারি না যদি আলমাছ সাহেব কোনো ঝামেলা করেন।তিনি হাসপাতালে শক্ত একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।
হাসপাতালে ভর্তি রোগী উপজেলার রাউৎগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা ইউছুফ আলী (৯০) বলেন, গত পাঁচ দিন ধরে শ্বাস কষ্ট, পেটের ব্যথা নিয়ে ভর্তি আছি। হাসপাতালে দুইবার সামান্য ভাত, এক পিস আলু, ছোট সাইজের মাছ-মাংস দেওয়া হয়। তরকারিতে মসলার পরিমাণ খুবই কম। মাছ-মাংস পুরোপুরিভাবে রান্নাও করা হয়নি। তিনি বলেন, আমি বৃদ্ধ লোক। খাবার খেতে গেলে বমি আসে। পৌর এলাকার জয়পাশা এলাকার বাসিন্দা আকলু মিয়া বলেন, চার দিন ধরে আমার স্ত্রী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি। এখানে খাবারের মান খুবই নিম্নমানের।
একই কথা জানালেন পৌর এলাকার বাসিন্দা শাহেদা আক্তার। তিনি বলেন, আমার ১১ মাসের মেয়ে মরিয়ম নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত। হাসপাতালের খাবার নিম্নমানের হওয়ায় বাইরে থেকে খাবার এনে খাচ্ছি। যে কয়েকবার মাছ দেওয়া হয়েছে, তা মাছের লেজ। কারণ হিসেবে রোগী ও অভিভাবকরা জানান, একেবারে নিম্নমানের খাবার, পরিমাণে কম। অরুচিকর হওয়ায় তারা খাদ্য নিতে নারাজ। ফলে রোগীরা নিজেদের বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন বা বাইরে থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মেসার্স শিউলী এন্টারপ্রাইজের আবু তালেব মুকুল ১৭ লাখ ৪৪ হাজার ২৯ টাকা পথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল উত্তোলন করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্সের মুক্তার আহমদ ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ৬৫০ টাকার বিল উত্তোলন করেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্সের মুক্তার আহমদ ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫০ টাকার বিল উত্তোলন করেন। এক বছরের ব্যবধানে ১৩ লাখ ২০ হাজার ৮০০ টাকা অতিরিক্ত বিল উত্তোলন করা হয়। কিন্তু চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি তারিখের ইজিপি টেন্ডারে দুইজন ঠিকাদার অংশ নেন। সেখানে এক বছরের জন্য সর্বনিম্ন ২০ লাখ ৭৪ হাজার ৮৯৮ টাকা পথ্য সরবরাহের রেইট দেন শিউলী এন্টারপ্রাইজ। অন্যদিকে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্স ৩০ লাখ ৪১ হাজার টাকা রেইট দেন। ইজিপি টেন্ডারের নিয়মঅনুযায়ী সর্বনিম্ন রেইট দাতা শিউলী এন্টারপ্রাইজ কাজ পওয়ার কথা থাকলেও কাগজ সঠিক নয় বলে অজুহাত দেখিয়ে হাসপাতালের আলমাছ আহমদের যোগসাজশে জুনেদ জাহিদ ট্রেডার্সকে পথ্য সরবরাহের টেন্ডার পাইয়ে দেয়া হয়।
এ বিষয়ে হাসপাতালের পথ্য ঠিকাদার মুক্তার আহমদ খাবারের পরিমাণ কম দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, খাবারে কিছুটা ত্রুটি থাকবে কারণ ভ্যাট-আইটি রয়েছে। ব্যবসায়ী হয়ে দেখেন কত হিসেব। খাবারে মাছ-মাংস পরিমাণ থেকে কম দেবার বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী দিচ্ছি। মসলাও পরিমাণ মতো দিচ্ছি।
হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক আলমাছুর রহমান বলেন, আমি ঠিকাদারের সাথে অংশীদার নই। যে কেউ এটা বলতে পারে কারো মুখতো বন্ধ করতে পারবোনা। সঠিকভাবে খাবার দেয়া হচ্ছে। খাবারের তদারকির দায়িত্ব টিএইচও ও আরএমও আছেন। তারা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। আমি কোন অনিয়ম করিনি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জাকির হোসেন বলেন, হাসপাতালের বাবুর্চি ও সহকারীকে সতর্ক করে বলেছি, পথ্য ঠিকাদার যাতে খাবারের পরিমাণ কম না দিতে পারে। প্রায়ই খাবারের উপকরণ ওজন করে দিচ্ছি। গত দুই মাস ধরে আমি দেখছি খাবারের মান ও ওজন ঠিক আছে। সংশ্লিষ্টদের সর্তক করেছি, তারা যেন ঠিকাদার দ্বারা প্রভাবিত না হন। তিনি বলেন, রোগীদের খাবারে অনিয়ম করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সম্প্রতি দুদকও হাসপাতালে এসে রন্ধনশালায় অনিয়মের বিষয়টি দেখতে পায়। পরে এ ব্যাপারে আমাদের মৌখিকভাবে সতর্ক করেছে।
সুত্র: কালেরকন্ঠ।