সিলেটের মাটির নিচে ঘুমন্ত দা ন ব : বুঝে ওঠার আগেই শেষ হয়ে যাবে সব!

সিলেট

গত ৩৮ ঘণ্টায় চার দফা ভূকম্পনে কেঁপে উঠেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। শুক্রবারের প্রাণঘাতী ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর শনিবার সকাল ও সন্ধ্যায় আরও তিনবার কম্পন অনুভূত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, এমন ঘনঘন ভূমিকম্প সিলেটের স্থানীয় ফল্টগুলো সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত, যা এই অঞ্চলের জন্য বড় ধরনের দুর্যোগের সতর্কবার্তা।

ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এরপর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে এক সেকেন্ডের ব্যবধানে পরপর দুটি ভূকম্পন (মাত্রা ৩.৭ ও ৪.৩) রেকর্ড করা হয়। মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগে নরসিংদীর মাধবদীকে উৎপত্তিস্থল করে হওয়া ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে দুই শিশুসহ অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে সিলেটের ঘন ঘন কম্পন নতুন করে আতঙ্ক বাড়িয়েছে।

সিলেটের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান বিশেষভাবে সংকটজনক। ডাউকি ফল্ট শহরের প্রায় ঘাড়ের ওপর দিয়ে বিস্তৃত, যার একটি বড় অংশ জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাটের নিচে সক্রিয়। পাশাপাশি ভারতের আসাম থেকে ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত কপিলি ফল্টও দীর্ঘদিন ধরে চাপ জমাচ্ছে—এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ দুই ফল্টের কোনো একটিতে বড় ধরনের শক্তি মুক্ত হলে সিলেট ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

অধ্যাপক মুশতাক আহমেদ মনে করেন, “ডাউকি ও কপিলি—দুটোই এখন সমান ঝুঁকিপূর্ণ। স্থানীয় ফল্টগুলো সক্রিয় থাকায় সিলেটে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।” স্থানীয় উৎপত্তিস্থলগুলো সক্রিয় হওয়ায় আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সুরমা বেসিনের নিচে বিস্তৃত সিলেট ফল্ট, সুরমা ফল্ট, আটগ্রাম–ভৈরব লাইনামেন্ট ও চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা ফোল্ড বেল্ট—সব মিলিয়ে সিলেট দেশের সবচেয়ে জটিল ভূকম্পন অঞ্চলের একটি।

সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সিলেটকে ঘিরে থাকা ডাউকি ফল্টের পাশাপাশি ভারতের আসাম থেকে ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত কপিলি ফল্টও এখন সমান ঝুঁকির উৎস। এ ফল্টে দীর্ঘদিন ধরে বিপুল শক্তি জমা হচ্ছে, যা মুক্ত হলে সিলেট ভয়াবহ ভূমিকম্পের মুখোমুখি হতে পারে।

এদিকে সিলেট সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ২০১৯ ও ২০২১ সালে যে ২৪ থেকে ২৫টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেগুলোর বেশিরভাগই এখনো ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুযায়ী এসব ভবন অপসারণ বা শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ কার্যত অগ্রসর হয়নি। বেশ কিছু বহুতল ভবনের সনদ নেই, আগুন বা দুর্যোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও নেই। পাশাপাশি নগরের সরু সড়কগুলো বড় ধরনের বিপর্যয়ে উদ্ধার অভিযানকে কঠিন করে তুলবে বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম।

এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে অন্তত ২০টির উৎপত্তি সরাসরি ডাউকি ফল্টের কাছে—যা বড় ধরনের শক্তি সঞ্চয়ের ইঙ্গিত বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটের বহুতল ভবনের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে—এমন সতর্কবার্তা বহু আগে থেকেই দেওয়া হয়েছে।

ফলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট যেন এক ঘুমন্ত দানবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই দানব ঠিক কখন জেগে উঠবে—তার কোনো নিশ্চিত পূর্বাভাস নেই। স্থানীয় ফল্টগুলোতে চাপ যে বাড়ছে, তা ধরা পড়ছে ছোট ছোট কম্পনে। কিন্তু বড় বিপর্যয় শুরু হওয়ার আগে সময় পাওয়া যাবে কিনা—সে নিশ্চয়তাও নেই।

এ অবস্থায় সতর্কতা, দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মোকাবিলা, ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশায় ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা—সবই এখন সময়ের দাবি। কারণ পদক্ষেপ নিতে দেরি হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সিলেটের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে প্রতিরোধ আর প্রস্তুতির বিকল্প নেই—নইলে কিছু বুঝে উঠার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে যেতেপারে

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *