সিলেট-৪: শ্রমিকের মন জয়ের মনোযোগে সবাই

সিলেট

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসন। জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ–এ তিন উপজেলাই প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। গ্যাস, খনিজ, বালু, পাথর ও প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্রের জন্য ব্যাপক পরিচিত। জাফলং, বিছনাকান্দি, লাল শাপলার বিল, রাতারগুল, সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান সিলেট-৪ নির্বাচনি এলাকায়। তামাবিল ও ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর ছাড়াও তিনটি উপজেলায় বালু-পাথরমহাল, চা-বাগান, গ্যাসক্ষেত্র হওয়ায় শ্রমিক জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ বরাবর নির্বাচনি এলাকার ভোটে প্রভাব রাখে। সম্পদ ও সম্ভাবনার মধ্যে সমস্যা জিইয়ে রাখার প্রবণতা ছিল অতীতে। সেই প্রবণতা ভাঙতে নির্বাচনি রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে মাঠে আছে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। ভোটের মাঠে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। শ্রমিক শ্রেণির মন জয়ের মনোযোগে ছুটছে রাজনৈতিক দলগুলো। ভোটে জেতার প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।

সিলেট অঞ্চলের সীমান্ত প্রান্তিক এই আসনটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৯৯৬ সালে, যখন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান এ আসনে নির্বাচন করেন। এর আগে ১৯৮৬ সালে ও ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন ইমরান আহমদ। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতির জ্যোতিষীখ্যাত রাজনীতিবিদ নাজিম কামরান চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জেতেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সাইফুর রহমানের সঙ্গে হেরে গেলেও পরে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন ইমরান।

সেই উপনির্বাচন থেকে ইমরানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন বিএনপির তখনকার নতুন মুখ দিলদার হোসেন সেলিম। ২০০১ সালের নির্বাচনে সেলিম বিজয়ী হন। এরপর ২০০৮ সালে সেলিম হারলে বিজয়ী হন ইমরান। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনে না যাওয়ায় ইমরান বিনাভোটে ফের এমপি হন। এরপর ২০১৮ সালে দুজনের মধ্যে আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও দিলদার হোসেন সেলিম পক্ষের দাবি, রাতের ভোটে বিএনপিকে হারানো হয়।

বিএনপিদলীয় সাবেক এমপি দিলদার হোসেন সেলিম করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ৫ মে মারা যান। দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে ছিলেন তার স্ত্রী জেবুন নাহার সেলিম। পাশাপাশি বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকী, গোয়াইনঘাট উপজেলার একাধিকবার নির্বাচিত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী, বিএনপি নেতা বদরুজ্জামান সেলিম ও সামসুজ্জামান জামান মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে ছিলেন।

গত ৩ নভেম্বর বিএনপির প্রথম দফায় মনোনয়ন ঘোষণার পর সিলেট-৪ আসন খালি রেখেছিল বিএনপি। সিলেট-১ (সদর-মহানগর) আসনে মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে ঢাকায় ঘুরে সিলেট এসে আরিফুল হক চৌধুরী জানান, তাকে সিলেট-৪ আসনে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দলের পক্ষ থেকে। এরপর তিনি নির্বাচনি এলাকা জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে প্রচার শুরু করেন। তবে যেহেতু দল থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি, তাই দলের অন্যান্য মনোনয়নপ্রত্যাশী আরিফুল হক চৌধুরীর এই ঘোষণা মেনে নেননি। এ নিয়ে তারা প্রকাশ্যে আরিফুল হক চৌধুরীর বিপক্ষে অবস্থান নেন। আরিফকে ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে এই আসনে ‘স্থানীয়’ কাউকে প্রার্থী করার দাবি জানান একাধিক প্রার্থী।

দলীয় প্রার্থিতা নিয়ে এ গোলোযোগময় পরিস্থিতির অবসান হয় গত ৪ ডিসেম্বর। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন সিলেট-৪ আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরীর নাম প্রকাশ করেন, তখন দৃশ্যপট বদলে যায়। কারণ বিএনপির পক্ষে এই আসনে আরিফুল হক চৌধুরী একজন শক্তিশালী প্রার্থী। আওয়ামী লীগ জমানায় সিলেট সিটি নির্বাচনে একটানা দুবার তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়ে ভোটের রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আরিফভীতি আছে এই আসনের অন্য দলের প্রার্থীদের মনেও। তাই আরিফুল হককে মনোনয়ন না দিয়ে এই আসনে ‘স্থানীয়’ কাউকে প্রার্থী করার দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছেন জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরাও।

সিলেট-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আরিফুল হকের নাম আসা নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আরিফুল হকের নাম এসেছিল। তিনি এ আসনের প্রার্থী হচ্ছেন বলে প্রচারও চলছিল। তবে আরিফ তখন জানিয়েছেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মতো পরিবেশ এলে সিলেট-৪ নয়, মহানগরীর আসনে (সিলেট-১) মনোনয়ন চাইবেন। ভোটের রাজনীতির শেষ অঙ্কে তিনি এখন সিলেট-৪ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েই সন্তুষ্ট।

সিলেট-৪ আসনে জামায়াতের প্রার্থী জয়নাল আবেদীন ২০১৮ সাল থেকে ভোটের মাঠে। তিনি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের পাশাপাশি জামায়াতের শ্রমিক সংগঠনেরও নেতা। বালু-পাথরমহালের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয়। এনসিপি মনোনীত রাশেল-উল-আলম ও খেলাফত মজলিসের মুফতি আলী আহসান উসামা মাঠে আছেন। প্রার্থিতায় জাতীয় পার্টি বা অন্য কেনো রাজনৈতিক দলের দৃশ্যমান তৎপরতা দেখা যায়নি। স্বতন্ত্র প্রার্থিতার আওয়াজ এখনো ওঠেনি।

জামায়াতের একটি সূত্র জানিয়েছে, ৮-দলীয় জোটের সমীকরণে এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী জয়নাল ৮-দলীয় জোটের প্রার্থী হলে ভোটের রাজনীতিতে নতুন দৃশ্যপটের উদয় হতে পারে। তবে ভোটের মাঠ মোটেই রাজনৈতিক নয় বলে জানিয়েছেন বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। তারা জানান, তিনটি উপজেলার বালু ও পাথরমহাল বন্ধ থাকায় সংশ্লিষ্ট শ্রমিক শ্রেণির বিরাট একটি অংশ বেকার। বেকারত্বের প্রভাবে তিন উপজেলার ভোট বালু-পাথরমহাল খোলার দাবি উচ্চারিত হচ্ছে। পাশাপাশি কোম্পানীগঞ্জ ছাড়া বাকি দুটি উপজেলার চা-বাগান শ্রমিকদেরও রয়েছে নানা সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধান ও এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের রোডম্যাপ নিশ্চিত দেখে ভোটাধিকার প্রয়োগ হবে।

জানা গেছে, সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে আয়তন ও ভোটার সংখ্যার দিক দিয়ে সিলেট-৪ আসনের পরিসর বেশ বড়। পাঁচ লক্ষাধিক ভোটারের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণি প্রভাবিত ভোটার সংখ্যা অর্ধেকের বেশি। এর মধ্যে বালু-পাথরমহালকেন্দ্রিক শ্রমিকদের মধ্যে বারকি শ্রমিক ও চা-শ্রমিক ভোটের বড় ফ্যাক্টর। বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ইতোমধ্যে তার প্রচারে শ্রমিক শ্রেণি ও সম্পদ-সম্ভাবনার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ভোটের মাঠে তার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের সদ্ব্যবহার ও বেকারদের কর্মসংস্থান করা হবে।

আরিফুল হক চৌধুরী সনাতন পদ্ধতিতে পাথর ও বালুমহাল খোলার কথা বলছেন। আরিফুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ নির্বাচনি আসন এটি। পাহাড়, হাওর, জলাবন, চা-ভূমি আছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র এখানে। এত সব সম্পদ থাকার পরও বিগত ১৭-১৮ বছরে এখানে কোনো দৃশ্যমান উন্নয়নই হয়নি। অথচ এখানকার প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ, বালু, পাথর সম্পদ ও চা-বাগান সারা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। আমি প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করার কথা বলছি। সম্পদের সদ্ব্যবহার হলে কর্মসংস্থানের অভাব হবে না।’

জামায়াতের জয়নাল আবেদীন পাথরমহাল খোলার দাবিতে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এ বিষয়টি তুলে ধরে শ্রমিক শ্রেণির ভোট টানার চেষ্টায় আছেন জয়নাল।

বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীর প্রচারে কিছুটা তফাতে কথা বলছেন এনসিপির প্রার্থী রাশেল-উল-আলম। এনসিপির মনোনয়ন ঘোষণার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ ও পর্যটন নিয়ে স্থানীয় ভাবনা নয়, সুদূরপ্রসারী ভাবনার বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্বাচনি এলাকা যুগের পর যুগ একই অবস্থায় থাকুক, এটা কেউ চায় না। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ত্রয়োদশ নির্বাচন উপলক্ষে ভোটার হালনাগাদ করার পর সিলেট-৫ আসনে এখন মোট ভোটার ৫ লাখ ২ হাজার ৬৫২ জন। ১৬৯ ভোটকেন্দ্রে স্থায়ী ভোটকক্ষ ৯৫৪টি। অস্থায়ী কক্ষ থাকবে ৪৭টি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে ভোটার সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজার ১২১ জন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *