সরকারের নয়, সিলেটের সড়কে ‘আইন’ চলে পরিবহন শ্রমিকদের!

সিলেট

সিলেটে আতঙ্কের অপর নাম পরিবহন শ্রমিক। যখন-তখন কর্মবিরতির নামে ধর্মঘট ডেকে তারা অচল করে দেন সিলেট। ন্যায্য দাবি থেকে অন্যায্য দাবিই তাদের বেশি। নিজেদের নিয়মবহির্ভুত কোনো কাজে বাঁধা আসলেই বেঁকে বসেন সিলেটের পরিবহন শ্রমিকরা। এমনকি নিজেদের মারামারির বিষয়েও সড়ক অবরোধ করে ভোগান্তিতে ফেলেন সিলেটবাসীকে। তারা যেন সড়কের অলিখিত রাজা। সরকারে নয়, তাদের নিয়মই চলে সড়কে।

বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা। হঠাৎ করে সড়ক অবরোধ করে পুরো সিলেট অচল করে দেন পরিবহন শ্রমকিরা। নিজেদের দুই গ্রুপের বিরোধ নিয়ে তারা রাস্তায় নেমে তাণ্ডব চালান সিলেটজুড়ে। প্রায় চার ঘণ্টা সিলেটের কোনো রাস্তায় একটি গাড়িও চলতে দেনি শ্রমিকরা। সিলেট মহানগরীর অন্তত ২৫টি স্থানে এলোপাতাড়িভাবে গাড়ি রেখে সড়ক অবরোধ করা হয়। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা রিকশা, এমনকি বাইক চলাচলেও বাধা দেন। জরুরি কাজে কেউ বাইক নিয়ে যেতে চাইলে তাদের হেনস্তা এমনকি মারধরও করা হয়।

এছাড়াও সিলেট জেলার প্রতিটি উপজেলা সদর ও বড় বাজারে ঠিক একইভাবে রাস্তায় এলোপাতাড়িভাবে গাড়ি রেখে সড়ক অবরোধ করেন পরিবহন শ্রমিকরা।

জানা যায়, পরিবহন শ্রমিকদের দুই গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলছে। এই বিরোধের জেরে সম্প্রতি লেগুনা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা মো. শাহাব উদ্দিনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। এর জের ধরে গত ৮ ও ১৪ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ সুরমা থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়।

শাহাবউদ্দিনের করা মামলায় সিলেট জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি মইনুল ইসলাম, সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি জাকারিয়া আহমদ, হিউম্যান হলার শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি রুনু মিয়া মইন ও আওলাদ মিয়াসহ অজ্ঞাত আরও ২০/২৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় মারপিট ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ আনা হয়।

বৃহস্পতিবার এই মামলার ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে যান পরিবহন শ্রমিক নেতারা। এরপর সন্ধ্যা থেকে আচমকা মহানগরীসহ সিলেটের সবগুলো সড়ক অবরোধ করে দেন শ্রমিকরা। মামলা প্রত্যাহার ও পুলিশ কমিশনারের অপসারণ দাবিতে বন্ধ করে দেন যান চলাচল। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়ে রিকশা, বাইক চলাচলেও বাধা দেন শ্রমিকরা। চালক এবং যাত্রীদের মারধরও করা হয়।

অবরোধে প্রায় অচল হয়ে পড়ে পুরো সিলেট। প্রতিটি রাস্তায় দেখা দেয় দীর্ঘ যানজট। সিলেট-ঢাকা মহাসড়কেও দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। অবরোধের কারণে কোনো গাড়ি সিলেট জেলায় প্রবেশ করতে বা বের হতে পারেনি পুরো ৪ ঘণ্টা।

সিলেটে পরিবহন শ্রমিকদের এমন তাণ্ডব নতুন নয়। নিজেদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া আদায়ে প্রায়ই কর্মবিরতির নামে ধর্মঘট ডেকে বসেন তারা। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে আদায় করে নেন নিজেদের দাবি। এর আগে ৫ দফা দাবিতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর দিনভর কর্মবিরতি পালন করেন পরিবহন শ্রমিকরা। এতে বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরনের যান চলাচল। এমনকি ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলেও বাধা দেয়া হয়।

নিজেদের স্বার্থে বারবার জনচলাচলে বাধা সৃষ্টি করা ও সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা হলেও পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো ব্যবস্থা। বরং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাই তাদের দাবি মেনে নিয়ে আপোষে বসেন। এতে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- পরিবহন শ্রমিকরা কি আইনের ঊর্ধ্বে? আর পরিবহন শ্রমিকরাই বা আইন মানতে নারাজ কেন? তারা কি এই দেশের বাসিন্দা নন?

বৃহস্পতিবার প্রায় চার ঘণ্টা নগর অবরোধ করে দুর্ভোগ সৃষ্টির পর এমন প্রশ্ন উঠছে আরও জোরেসোরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন সচেতন মহল। পরিবহন শ্রমিকদের কাছে সিলেটের মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে বলেও মনে করছেন সিলেটবাসী। তাদের এমন কার্যকলাপ প্রতিরোধে পাড়ায় পাড়ায় নাগরিক কমিটি গঠন করা এখন সময়ের দাবি বলে অনেকের বক্তব্য।

সিলেট জেলা পুলিশের পরিদর্শক শ্যামল বণিক ফেসবুকে একটি ছবি যুক্ত করে লিখেছেন, ‘হাইওয়ে রাস্তায় দাউদাউ আগুন জ্বলতে দেখে ভয়ে সব গাড়ি থেকে নেমে যাত্রীরা যখন ছুটাছুটি করছে, তখন অসহায় অন্ধ ব্যক্তিটি তার শিশু সন্তানকে নিয়ে কান্না শুরু করেছে। তাদের অনেক কষ্টে নিরাপদে বাস স্ট্যান্ড পৌঁছিয়ে দিলাম।’

এই পুশি কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘মুহূর্তেই এরা বা ওরা যেভাবে এক হয়ে যায়, এইভাবে যদি দেশের সৎ আর সচেতন মানুষগুলো এক হতে পারত, তাহলে দেশের অসহায়দের কষ্ট দূর হয়ে যেত।’

তবে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য ভিন্ন। পুলিশের কারণেই সিলেটের মানুষকে এমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে দাবি করেন সিলেট জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি মইনুল ইসলাম। শুক্রবার তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘১৩ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে, তার অপসারণ দাবিতে। আর বৃহস্পতিবারের দুর্ভোগের দায় মহানগর পুলিশ কমিশনারের।’

তিনি বলেন, ‘মামলার খবর শুনে আমাদের নেতা-কর্মীরা পুলিশ কমিশনারের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের আশ্বাস দেয়া তো দূরের কথা, উল্টো দুর্ব্যবহার করেছেন। আরো মামলার হুমকি দিয়েছেন। এই দুর্ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকরা অবরোধ করেছে। ক্ষোভ থেকেই আমরা মানুষকে কষ্ট দিয়েছি, নিজেরাও কষ্ট করেছি।’

এদিকে, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র বলছে- সিলেটে বৈধ অটোরিকশার চেয়ে অবৈধ অটোরিকশা বেশি। অনেক বাস চালকের রেজিস্ট্রেশন নেই, গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেই পরিবহন শ্রমিকরা একজোট হয়ে আন্দোলনে নেমে যায়। তারা কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমত গাড়ি চালানোর স্বাধীনতা চায়। জনগণের ভোগান্তি লাঘবে তাদের ব্যাপারে পুলিশকেও অনেক সময় পিছু হটতে হয়।’

এ বিষয়ে শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে এসএমপি কমিশনার নিশারুল আরিফ সিলেটভিউ-কে বলেন, ‘কিছু ঘটলেই তারা যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। মানুষজনকে চলাচলে বাধা দেয়। এতে মানুষজন চরম দুর্ভোগে পড়েন। তারা এভাবে বার বার জনদুর্ভোগ তৈরি করছেন, তবু পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা শক্তি প্রয়োগ বা আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছি না। কারণ এখন এসএসসি পরীক্ষা চলছে, সামনে দুর্গাপূজা, এরপর সিলেটে নারী এশিয়া কাপ। এসব কারণে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছি। ফলে আমরা অনেকটা নমনীয় আচরণ করছি। তবে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *