হজরত নূহ (আ.) এর সময়ে ঘটে যাওয়া প্লাবনের পটভূমিতে নির্মিত হলিউডের ‘নোয়াহ্’ মুভিটি যারা দেখেছেন তারা দৃশ্যটি কল্পনা করতে পারবেন। হঠাৎ করেই নদীর পানি উপচে প্রবল বেগে ঢুকে পড়ছে বিস্তীর্ণ জনপদে। ঘরের মধ্যে বুক পর্যন্ত পানি, ওপর থেকে মুষলধারে অবিরাম বৃষ্টি, বিদ্যুৎ নেই, সঙ্গে মুহুর্মুহু গগণবিদারী বজ্র পাত! প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে অনেকের ঘরবাড়ি। যারা ঘরের চালে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারাও বুঝতে পারছিলেন না যে শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচতে পারবেন কিনা?
এমন ঘনঘোর দুর্যোগের তৃতীয় দিন শোনা যাচ্ছিল—ওই পরিস্থিতি চলবে সাতদিন পর্যন্ত! তখন বিপুলসংখ্যক মানুষ সত্যিই দিশেহারা হয়ে পড়ে। পরিবারের অসুস্থ, শিশু ও বৃদ্ধ সদস্যদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রান্তিক এলাকার কথা বাদই দিলাম। সিলেট সিটি করপোরেশনের কিছু এলাকা পাঁচদিন পর্যন্ত ছিল বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন।
ফলে সংগত কারণেই পানীয় জলের সংকট প্রবল হয়। বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে থেকেও তারা ব্যবহারের মতো পানির জন্য হাহাকার করতে থাকে। একদিকে সেলফোনের নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করছে না, অন্যদিকে ডিভাইসের চার্জ দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগের শেষ অবলম্বনটুকুও হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কায় পড়েন অনেকে।
শুধু বন্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরাই নয়, বরং বিদ্যুৎকেন্দ্র ডুবে যাওয়ার খবরে শহরের বহুতল ভবনে বাসকারীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাসের সরবরাহ যেকোনো সময় বিচ্ছিন্ন হতে পারে এমন ভয় ছিল। তাছাড়া এখন বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে। বন্যার তীব্রতা আরো বাড়লে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমন প্যানিক সৃষ্টি হওয়ায় ১ হাজার ২০০ টাকার সিলিন্ডার ৫ হাজার টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছিল না। ৫ টাকার মোমবাতি কোথাও বিক্রি হয়েছে ১০-২০ গুণ দামে! চিড়া-মুড়ির মতো (অন্য সময়) অবহেলিত পণ্যগুলোও দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। কোনো দোকানে পাওয়া গেলেও দাম গুনতে হয় কয়েক গুণ বেশি!
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বেশির ভাগ পানি সিলেট পেরিয়ে দ্রুতগতিতে যাচ্ছিল সুনামগঞ্জের দিকে।সেখানে শুরুতে অনেকেই ভেবেছিল বৃষ্টি কিছুটা কমলে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাবেন। কিন্তু সে সময় আসার আগেই অনেকের ঘর প্রবল স্রোতে ধসে পড়ে। কিছু মানুষ টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু বিপুল স্রোতের কারণে সেখান থেকে কোথাও যাওয়ার ফুরসত পাচ্ছিল না।
কোরবানির ঈদ সামনে রেখে গবাদি পশু পালনকারীরা ছিলেন শেষ সম্বলটুকু হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে তটস্থ। তাছাড়া শত শত মাছের ঘের-পুকুর-জলাশয় বিস্তীর্ণ জলরাশির সঙ্গে একাকার হয়ে যায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে।অনেকে বলছেন, গত ১০০ বছরে এমন বন্যা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষ দেখেনি। ফলে এর তাণ্ডব ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই কঠিন।
কাছাকাছি সময়ে চট্টগ্রাম ও দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার প্রকোপ বাড়ে। দেশের প্রায় ২০টি জেলা তখন জলমগ্ন ছিল। তার পরও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বন্যার ব্যাপকতা সবাইকে স্পর্শ করে।উপদ্রুত এলাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছুটে আসা, সেনাবাহিনী প্রধানের একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন, সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর পাশাপাশি বিজিবির তত্পরতা প্রমাণ করে যে এ সংকটের গভীরতা গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সিলেটের রেল-সড়ক-বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে এ খবর প্রচার করে। প্রবাসে অবস্থানরতদের কষ্টের তীব্রতা প্রকাশ পায় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে।
তবে বন্যা পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করার স্বল্প সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনীর উদ্ধার ও ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ আক্রান্তদের বিশেষভাবে সাহস জুগিয়েছে। বহু স্থানে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করে সশস্ত্র বাহিনী তাদের ঐতিহ্যকে করেছে আরো সমুন্নত।এখনো সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাদের অংশগ্রহণের ফলে বরাদ্দকৃত দ্রব্যাদি সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাত পর্যন্ত পৌঁছেছে। নইলে প্রচলিত পন্থায় সেগুলো করতে গেলে আবুল মনসুর আহমদের ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ গল্পের অবস্থা হওয়া অসম্ভব ছিল না।
এবারের বন্যায় সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক ছিল স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার উদ্যোগ। দুর্যোগ শুরুর স্বল্প সময়ের মধ্যে তারা যেভাবে ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এখনো প্রতিদিন সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কে খাদ্য ও পানীয় বহনকারী শত শত ট্রাক যাচ্ছে। এর অধিকাংশই বেসরকারি উদ্যোগে সংগৃহীত ফান্ড থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামগ্রিক এ কার্যক্রমে সমন্বয়ের ঘাটতি দৃশ্যমান ছিল। প্রত্যন্ত কিছু অঞ্চলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ত্রাণ পৌঁছেনি। আবার কিছু অঞ্চলে বারবার গিয়ে বিভিন্ন দল সহায়তা করেছে।সমন্বয় সেল বা তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে ব্যাপারটা মনিটর করলে আরো সুফল পাওয়া যেত। তার পরও সবার আন্তরিকতার কাছে সেই দুর্বলতাগুলো ঢাকা পড়েছে।
পৃথিবীর ধনী রাষ্ট্রগুলোর জনগণের সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্যের জায়গা হলো, সেখানে সবাই সরকারি সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যেকোনো বিপদে তারা রাষ্ট্রের সাহায্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের জনগণ প্রথমত নিজেরা টিকে থাকার সর্বোচ্চ লড়াই করে। সব দুর্দশা কাটিয়ে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তত্পর হয়। অন্যদিকে আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ফলে যত বড় দুর্যোগই হোক না কেন কিছুদিন পরেই আমরা দিব্যি ভুলে যেতে পারি। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠি দৈনন্দিন কার্যক্রমে।
কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের পরে সব কর্তৃপক্ষ খুব তত্পর থাকে যতক্ষণ সেই ঘটনা মিডিয়ার হেডলাইন বা ব্রেকিং নিউজে থাকে। যেমন তিন সপ্তাহ না যেতেই চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি! ফলে মিডিয়ার মনোযোগ অন্যদিকে সরে যাওয়ামাত্রই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থাগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সবকিছু চলতে থাকে আগের গতিতে। তাই কোনো দুর্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সাধারণত করণীয় নির্ধারণ কিংবা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি না।
এখন কথা হলো, এবারের বন্যা চলে গেলেই কি আমরা পুরোপুরি বিপদমুক্ত হয়ে গেলাম? আবার আগের গতিতে সবকিছু চলতে থাকবে? নিজেদের খেয়ালখুশিমতো প্রকৃতির ধ্বংসলীলা সাধন করব? অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শী প্রকল্প হাতে নেব? নদী ও খাল খননের কাজে ব্যাপক দুর্নীতি করব? হাওর দখল করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করব? প্রকৃতির লাইফলাইনগুলো কব্জায় নিয়ে যা খুশি তাই করব? আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ন্যায্য হিস্যা ও পানির সুষ্ঠু বণ্টন বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেব না?
না, তেমনটা করার সুযোগ দ্রুতই সংকুচিত হয়ে আসছে।বছর বিশেক আগে যখন বিশ্ব উষ্ণায়ন কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা শুরু হয় তখন আমরা ভাবতাম, লক্ষণীয় পরিবর্তন আসতে হয়তো কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে। কিন্তু তা এত দ্রুত যে বিশ্ববাসীকে নাজেহাল করবে তা অনেকে হয়তো কল্পনাও করেননি।
এটা স্পষ্ট যে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামনে ক্রমেই বাড়বে। পানীয়জলের সংকট প্রবল হবে। সিঙ্গাপুরের মতো অনেক দেশকেই আমদানি করা পানির ওপর নির্ভর করতে হবে।এ অঞ্চলে পানির সংকট কত ভয়াবহরূপে আবির্ভূত হতে পারে তা অনুভবের জন্য বলিউডের ‘জল’ মুভিটি দেখতে পারেন। যা এখনো আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।
তাহলে আমাদের করণীয় কী? হাতপা গুটিয়ে বসে থাকব আর দুর্যোগ এলে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়ব? না, বরং ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম’—এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়া দরকার। প্রত্যেক ব্যক্তি ও সংস্থাকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সামগ্রিক সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে না তুললে ভবিষ্যতে টিকে থাকা সত্যিই কঠিন হবে। ছোট্ট অথচ বিপুল জনসংখ্যার এ দেশের দক্ষিণাংশ পানিতে ডুবলে বা উত্তর-পশ্চিমাংশ মরুভূমির বৈশিষ্ট্য ধারণ করলে তার ভার আমরা সইতে পারব না।
তাই পানি ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে মিলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন জরুরি।নদীগুলো যেন আরো বেশি পানি ধারণ ও বহন করতে পারে সেই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় স্থানগুলোয় অতিদ্রুত শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। হাওরের মতো প্রাকৃতিক জলাধারগুলো দখলদারদের হাত থেকে অবিলম্বে উদ্ধার করে সেগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। অবকাঠামো নির্মাণে রাজনৈতিক নেতাদের ‘প্রত্যাশা’-কে বিশেষজ্ঞ মতামতের সঙ্গে সমন্বয় করে তবেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। পরিবেশ রক্ষায় বরাদ্দকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়াতে হবে।
সর্বোপরি কথা হলো, এই জাতীয় কাজে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় দুর্নীতি হয়। নদী খনন, হাওরের বাঁধ নির্মাণ কিংবা শহরের খাল ও ছড়া পরিষ্কার—সব ক্ষেত্রে চিত্র মোটামুটি একই রকম বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা তা বুঝে নেয়ার জন্য সরকারি সংস্থার পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন হতে হবে। কারণ কতিপয় ব্যক্তির লোভের কারণে বিপুল জনগোষ্ঠীর জানমাল বারবার হুমকির মুখে পড়তে পারে না। সেটা হওয়া উচিত নয়।
ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক
শেয়ার করুন
2VvJlESIZCp35RgGCzLglTlGJra