অতিরিক্ত ডিভাইসনির্ভরতায় নতুন প্রজন্মের ঝুঁকি

মুক্তমত

অতিরিক্ত ডিভাইসনির্ভরতায় নতুন প্রজন্মের ঝুঁকি:ড. মো. আব্দুল হামিদ

অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন। নিজের রূপ বা গুণের প্রশংসা চান না এমন মানুষ আজকাল সত্যিই বিরল। কিশোর ও তরুণদের মাঝে এ প্রবণতা স্বভাবতই বেশি থাকে। হয়তো সে কারণেই আগে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও সহপাঠীদের কাছে স্মার্ট বলে গণ্য হওয়ার বিশেষ চেষ্টা লক্ষ করা যেত। সেই লক্ষ্যে অনেকেই বিশেষ দক্ষতা ও গুণাবলী অর্জনে সচেষ্ট থাকত।

এই ধারায় আকস্মিক বড় পরিবর্তন আনে স্মার্ট ডিভাইস ও ইন্টারনেটের বিপুল বিস্তার। এখন প্রত্যেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর হাতে রয়েছে একাধিক টিভি চ্যানেল! তারা চাইলেই নিজের বৈশিষ্ট্যগুলো টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে তুলে ধরতে পারে। এমনকি শুধু ভাঁড়ামো বা আপত্তিকর অডিও-ভিডিও ছেড়েও অনেকে সেটা অর্জনে সচেষ্ট রয়েছে।

রাতারাতি সফলতা পেতে বহু অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদেরও ব্যবহার করছেন। গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনে শিশুদের ব্যবহার বেশ পুরনো চর্চা। কারণ শিশুর প্রতি স্নেহ সার্বজনীন ও খুব কার্যকর এক হাতিয়ার। তাই জন্মগতভাবে সুন্দর অবয়ব বা আদুরে গলায় কথা বলতে পারা শিশুর অভিভাবকেরা চ্যানেল খুলে তাদের ভিউ বাড়াতে ব্যস্ত। সেগুলোর বিষয়বস্তু নিত্যদিনের খুনসুটি, নাচ-গান, উদ্ভট আচরণ প্রভৃতি।

অন্যদিকে ধর্মীয় আলোচনার মঞ্চে কৈশোর না পেরুনো শিশুদের দিয়ে পাকা পাকা কথা বলানো হয়। নিজে কৈশোর না পেরুলেও আঙুল নাচিয়ে যুবকদের নসিহত করতে দেখা যায়! আপাতদৃষ্টে কিছু ভিউ বা লাইক মা-বাবাকে তৃপ্ত করতে পারে। কিন্তু তারা বোঝেন না যে এর মাধ্যমে নিজেদের সন্তানদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন।

আমরা জানি, প্রত্যেক কাজের জন্য উপযুক্ত বয়স থাকে। খুব ব্যতিক্রম, অনন্য মেধাবী কিংবা মিরাকল বেবি হলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু সাধারণ ক্ষেত্রে অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ, গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া এবং সেটা টেকসই করার জন্য শক্ত ভিত দরকার হয়। সৃজনশীল নানা ক্ষেত্রে যারা উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছেন তারা জীবনের প্রথম পর্যায়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে, নানা ত্যাগ স্বীকার করে আজকের ‘তারকা’ পর্যায়ে এসেছেন।

জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত কেউ তাদের চিনত না। সেভাবে পাত্তা দিত না। তখন নীরবে-নিভৃতে তারা প্রত্যাশিত ক্ষেত্রে চর্চা ও সাধনা করে গেছেন। ফলে তারা যখন লাইমলাইটে এসেছেন তখন তা ক্যারি করতে সমস্যা হয়নি। তাদের সফলতা দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই হয়েছে। অনেকে জীবনভর নিরলস চেষ্টা ও সাধনায় সেই অর্জন অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। নানা প্রলোভন বা পরিবর্তিত পরিস্থিতি তাদের বিচ্যুত করতে পারেনি।

অন্যদিকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বা সহজে যারা সফলতা পান তাদের আর নিজেদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ অবশিষ্ট থাকে না। প্রথম দিকে কিছু কাজ দিয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন না। আবার নতুন কিছু শেখা বা সমৃদ্ধ হওয়ার মানসিকতাও থাকে না। ফলে তাদের তথাকথিত ‘সেলিব্রেটি ইমেজ’ দ্রুতই পড়তে থাকে। পড়ালেখা, জ্ঞানার্জন, অধ্যবসায় তো আগেই বিদায় নেয়। ফলে একসময় ‘হতাশা’ তাদের নিত্যসঙ্গী হয়।

নিজেকে স্টার ভেবে তেমন ব্যয়বহুল জীবনযাপনে সচেষ্ট থাকে। কিন্তু আয়-ইনকাম সেভাবে হয় না। তখন কেউ কেউ অন্ধকার গলিতে পা বাড়ায়। কেউ বা জড়িয়ে পড়ে নানা কেলেংকারিতে। এভাবে বহু জীবন অকালে নষ্ট হয় মা-বাবার অতিরিক্ত লোভ বা সংশ্লিষ্টদের দূরদৃষ্টির অভাবে। তাই শক্তিশালী ডিভাইস হাতের নাগালে থাকলেই তার যথেচ্ছ ব্যবহারে সতর্ক হওয়া দরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হুমকির মুখে ফেলার আগেই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা জরুরি।

আমরা জানি, প্রযুক্তি পণ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটা পুরনো অনেক কিছুকে শেষ বা নাই করে দেয়। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় স্মার্টফোন হলো তার জ্বলন্ত উদাহরণ। আক্ষরিক অর্থে নিলে এটা এরইমধ্যে শতাধিক পণ্যের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এমনকি রেডিও, টেপরেকর্ডার, স্ক্যানার, ডায়েরি ও ক্যামেরার মতো অনেক পণ্য বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এর পরোক্ষ প্রভাব আরো ব্যাপক।

ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ক্ষেত্রেই সেটা হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে অধিকাংশ কিশোর ও তরুণ স্বভাবতই খারাপ দিকে ঝুঁকছে। ফলে একসময় তা মানব অস্তিত্বের জন্য হুমকি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নানা গবেষণা বলছে, লাইফস্টাইলের ব্যাপক পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা সে পথে অনেকটাই এগিয়েছি।

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটা উপলব্ধি করার পরেও আমরা কেন মেনে নিচ্ছি বা এই প্রবণতায় রাশ টানছি না? নিঃসন্দেহে অসংখ্য কারণ রয়েছে। তবে অন্যতম কারণ হলো বড়োরাই নিত্যদিন এসব স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করতে গিয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। তাছাড়া নগরজীবনে পরিবার কাঠামোয় বদল, বাইরে সন্তানদের নিরাপত্তাঝুঁকি, সুস্থ বিনোদনের অভাব, খেলাধুলার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা, কর্মজীবী মা-বাবার ব্যস্ততা প্রভৃতি কারণে পরিবারের নবীন সদস্যদের এসব ডিভাইসের ব্যবহার মেনে নিতে হচ্ছে।

তাদের বয়সের বৈশিষ্ট্যের কারণেই নিজের ভালোমন্দ বোঝা কিংবা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়। ফলে অনেক পরিবারে শিশুরা ডিভাইসের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। গত একদশকে এর আওতা ও গভীরতা উভয়ই বেড়েছে।

করোনা মহামারী সেই পালে বিশেষভাবে হাওয়া দিয়েছে। যে মা-বাবা এর আগে সন্তানদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে অতি সতর্ক ছিলেন। সেগুলোর ব্যবহারে পরিবারে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করতেন। তারাও অনলাইন ক্লাসের জন্য সন্তানদের সেগুলো দীর্ঘসময় ব্যবহার করতে দিতে বাধ্য হন। বহু পরিবারে তাদের আলাদা ডিভাইস কিনে দিতে হয়। তাতে অসংখ্য পরিবার নানামুখী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

স্বাধীনভাবে নিজস্ব ওই ডিভাইসের ব্যবহার বহু কিশোর ও তরুণকে শুধু ইঁচড়ে পাকা বানায়নি বরং বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হয়েছে। নিষিদ্ধ গ্রুপের সদস্য হয়ে নানা অপকর্মে শামিল হয়েছে। কেউবা মাদকের বিস্তারকারী গ্রুপের সান্নিধ্যে চলে গেছে। এমনকি অনেকে অনলাইনে সক্রিয় জঙ্গিবাদের খপ্পরে পড়েছে। তেমন প্রেক্ষাপটে সশরীরে ক্লাশ শুরু হওয়ায় বহু অভিভাবক হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যরা প্রায় দুই বছর ডিভাইস ব্যবহারের অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিল। বন্ধু ও সহপাঠীদের সঙ্গে সশরীরে সাক্ষাৎ কিংবা আড্ডার প্রবণতা বাড়ছিল। এমন সময় নতুন পাঠ্যক্রম তাদের আবারো সেদিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে।

বিশেষত শহরের স্কুলগুলোয় পড়া একেকটি শিশু দিনে কয়েক ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। অভিভাবকরা চাইলেও তা হ্রাস করতে পারছেন না। রাত জেগে পরবর্তী দিনের প্রজেক্ট করতে হয় যার অধিকাংশই ইন্টারনেটভিত্তিক। এমনকি রাত ১০টার পরেও বহু স্কুল থেকে পরবর্তী দিনের কাজের নির্দেশনা আসে। তখন তারা সেটা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ চ্যাট করে।

মা-বাবা সারাদিন পরিশ্রমের পর কিংবা পরের দিন সকালে বের হওয়ার তাগাদায় খুব বেশি সময় তাদের তদারক করতে পারেন না। ফলে কিশোররা নিজেদের মতো করে ডিভাইসগুলো ব্যবহার করছে। গভীর রাতে ঘুমাতে যাচ্ছে, স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। বহু মা-বাবা সন্তানদের এমন বিশৃঙ্খল রুটিনে বিপর্যস্ত বোধ করছেন।

বহু অভিভাবক আগে নিজেরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন না। কারণ তাদের কাজকর্ম বা দৈনন্দিন জীবনে সেটা ব্যবহার না করলেও চলত। কিন্তু এখন শুধু সন্তানদের পড়ালেখার জন্য তা নিয়মিত কিনতে হচ্ছে। অনেক পরিবারে বড়োদের ফিচার ফোন থাকলেও ছোটদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত স্মার্ট ডিভাইস কিনতে হচ্ছে!

দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ঠিক কত শতাংশ অভিভাবকের এ সামর্থ্য রয়েছে সে বিষয়টি কী আমাদের নীতিনির্ধারকগণ বিবেচনায় নিয়েছেন? তার চেয়ে বড় কথা হলো যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারাই বা কেন প্রিয়তম সন্তানদের এমনভাবে ডিভাইসে আসক্ত হতে দেবেন? কিশোর বয়সে এমন আসক্তি অনেককে চিরতরে পড়ালেখাবিমুখ বা পঙ্গু করে দিতে পারে।

প্রথমদিকে এসব ডিভাইস দীর্ঘসময় ব্যবহারের শারীরিক প্রভাব নিয়ে কথা হতো। অর্থাৎ এমনটা চলতে থাকলে শিশু-কিশোরদের চোখের ভীষণ ক্ষতি হয়। অল্পতেই মাথা ধরে যায়। দীর্ঘসময় কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না। ঘাড় ব্যথা হয়। এমনকি অনেকের মেরুদণ্ডে স্থায়ী সমস্যা হয়। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করেও প্রতিকার পাওয়া যায় না। তাছাড়া দীর্ঘক্ষণ বসে সেগুলো ব্যবহার করায় শিশুদের শারীরিক গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দৌড়ঝাঁপ বা শারীরিক শ্রমসাধ্য খেলাধুলায় অংশ নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

এসব স্মার্ট ডিভাইস দীর্ঘ সময় ব্যবহারের মানসিক প্রভাব অকল্পনীয়। তারা বিনোদনের জন্য যেসব কনটেন্ট দেখে তা স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনায় প্রস্তুত নয়। ফলে নিজেদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা থেকে ক্রমেই দূরে সরতে থাকে। উদ্ভট ও বিকৃত আচরণকারী ব্যক্তিরা (ইনফ্লুয়েন্সার) তাদের মডেল বা আইকনে পরিণত হয়। এতে কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণকালে তাদের অনেকেই বসবাস করতে শুরু করে কল্পনার জগতে। পরিবার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিকতা বা মূল্যবোধ শেখা থেকে হয় বঞ্চিত।

তদুপরি তাদের শারীরিক ও মানসিক চাপ নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। অল্পতেই আবেগপ্রবণ হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। সামান্য ঘটনায় রেগে যাওয়া বা কান্না করতে দেখা যায়। অনেকে অভিমানে (আত্মহত্যার মতো) বড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। অন্যদের ডিপ্রেশনে ভোগা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়। কেউবা হয় মাদকে আসক্ত। অনেকেই হয়ে পড়ে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত।

পরিশেষে বলব, শিশুরা পরস্পর মিলেমিশে ও দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে শেখাটা খুবই দরকারি। কিন্তু তার জন্য স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। না হলে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দলীয় কাজ দিলে বিষয়টা হবে সেই দুষ্টু ছেলের মতো। সে সারা দিন ঘরে বসে ট্যাব নিয়ে গেমস খেলত। একদিন মা রাগ করে বলল, সারা দিন ঘরে বন্দি থাকিস, একটু সময় বাইরে গিয়ে খেলতে পারিস না? তখন সুবোধ ছেলেটা মাঠে গিয়ে ঘাসের ওপর বসে সেই ডিভাইসে গেমস খেলতে শুরু করল!

পারিপার্শ্বিক সামগ্রিক অবস্থা এমনিতেই শিশু-কিশোরদের ডিভাইসমুখী করছে। স্কুলগুলো তাতে আবার হাওয়া দিলে ‘একে তো নাচুনি বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি’ খনার বচনটি মনে পড়ে যায়। তাই দয়া করে শিশুদের ডিভাইসের কাছে নয় বরং মানুষের কাছে নিতে শিক্ষাপদ্ধতির উদ্ভাবন করুন। তাদের প্রয়েজনীয় দক্ষতার পাশাপাশি মানবীয় গুণাবলীর বিকাশে সহায়ক হোন।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক। উৎস: ২৯ নভেম্বর ২০২৩।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *